উপকূলের চারদিকে পচা দুর্গন্ধ, সর্বস্বান্ত করেছে নোনা পানি
‘এট্টার পর এট্টা ঝড় বন্যা আসে আর আমাগের সব শেষ করে দিয়ে যায়। ঝড় হলি বাল্লা (বাঁধ) ভাইঙ্গে নোনা পানিতে সব তলাই যায়। বন্যা শেষ হলিও তার রেশ থাইকে যায়। নোনা পানিতে সবকিছু নষ্ট করি দেয়। পইচে যাইচ্ছে মাছ-শাক সব। চারিদিক পচা দুর্গন্ধ ছড়ায় পড়িছে। বছরের পর বছর এইভাবে চলতি হুতিছ (হচ্ছে)। এই সমস্যা নে (নিয়ে) বাইচে আছি। কেউ সমস্যা দূর করতি পারতেছ (পারছে) না।’
খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ভাঙন-কবলিত গাতিরঘেরি এলাকার খাদিজা (৬০) ও আয়শা বেগম (৪৫) এভাবেই আফসোস প্রকাশ করেন।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় তাদের সবকিছু। পুকুরের মাছ মরে পচে গেছে লবণাক্ততার কারণে। মরেছে হাঁস-মুরগিসহ গবাদিপশু। সবদিকে পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি।
শুধু ইয়াস নয়, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূল তার ভূ-প্রকৃতিগত ভারসাম্য হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ ঠেকাতে নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণেই টিকছে না এসব বাঁধ, দেখা দিচ্ছে নদী ভাঙনও। মাছের ঘেরে অতিরিক্ত লবণপানি প্রবেশ করানোয় বেড়িবাঁধগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ পরিবেশবিদদের।
গত দেড় দশকে সিডর, আইলা, মহাসেন, কোমেন, নার্গিস, মোরা, বুলবুল ও আম্পান, ইয়াসসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের নতুন নামে আঘাত হানছে প্রলয়ঙ্কারী সব ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস। লবণাক্ততা বেড়ে খুলনা উপকূলে নদী-তীরবর্তী এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে।
সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এক বছর পার হতে না হতেই আবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। গত ২৬ মে ইয়াসের আঘাতে আবার প্লাবিত হয়ে উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। বেড়িবাঁধগুলো টেকসই না হওয়ায় এখনো শঙ্কিত উপকূলের লাখো মানুষ।
দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে খুলনার কয়রা একটি। এ উপজেলার বাসিন্দা নিশিত রঞ্জন মিস্ত্রি জানান, দুর্যোগ-কবলিত এ জনপদের মানুষ ভাঙাগড়ার মধ্যেই দিনাতিপাত করছে। একটির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের নতুন নামে আঘাত হানছে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু মানুষ। পরিবারগুলো জমি ও সম্পদ হারিয়ে এখন উদ্বাস্তু।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, উপকূলের মানুষ জন্মগতভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে শিখেছে। এ কারণে বড় ঝড়বৃষ্টি তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না। কিন্তু নদীর বাঁধ ভেঙে গেলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কারণ এ সময় পানি তাদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, তা মোকাবিলার শক্তি তাদের নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বেড়িবাঁধ বা পোল্ডার নির্মাণ প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বরং টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্টের (টিআরএম) ওপর জোর দেয়ার কথা বলছেন তারা।
পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোট খুলনার সদস্য সচিব ইকবাল হোসেন বিপ্লব বলেন, অতিরিক্ত লবণ পানির কারণে ফসলের ক্ষেত পচে গেছে। ঘের ও পুকুরের মাছও মরেছে অনেকের। লবণ পানি পানে মরেছে হাঁস-মুরিগসহ গবাদি পশু। পচা পানির দুর্গন্ধে উপকূলের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ না হওয়ায় বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে উপকূলের গ্রামগুলোতে। এতে প্রতিবারই পবিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে উপকূল। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা বারবার টেকসই বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
এদিকে উপকূল রক্ষায় বেশ কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদ বলেন, প্রতিবছর উপকূল লন্ডভন্ড হয়। এতে কপাল ভাঙে সাদাসিধে গরিবের। আর কপাল ভালো হয় গুটিকয়েক মানুষের।
খুলনা-৬ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আলহাজ মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ষাটের দশকে তৈরি বেড়িবাঁধ সক্ষমতা হারিয়েছে। ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া মাটির তৈরি বাঁধের অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। কোথাও কোথাও একেবারে নেই। ফলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকার আট হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চলতি বছরেই এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
এসআর/এমকেএইচ