বর্জ্যে ‘বিষাক্ত’ শীতলক্ষ্যায় অস্তিত্ব হারাচ্ছে জলজ প্রাণী
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এ নদী ঘিরে স্বাবলম্বী হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্রমে নদীর পাশ্ববর্তী এলাকায় শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে শুরু করে বহু প্রতিষ্ঠান। কালের পরিক্রমায় শীতলক্ষ্যা ঘিরে গড়ে উঠেছে এখন ৪১৭টি কল-কারখানা।
যার মধ্যে ১০৫টি কারখানার কোনো বর্জ্য শোধনাগারই (ইটিপি) নেই। ফলে এসব কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হয় শীতলক্ষ্যায়। বাকি ৩১২টি কারখানার নামেমাত্র শোধনাগার থাকলেও তা ব্যবহার না করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে গোপনে অথবা কৌশলে তারা শীতলক্ষ্যায়ই ফেলে দূষিত বর্জ্য।
পরিবেশবিদ, গবেষক ও স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা বলছেন, কারখানার দূষিত বর্জ্যে শীতলক্ষ্যার পানি মাঝেমাঝে আলকাতরার রঙ ধারণ করে। ফলে নদীতে এখন আর কোনো জলজ প্রাণী, উদ্ভিদের অস্তিত্ব নেই। অসহনীয় দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকে বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র বাসস্থান গড়ছেন।
শনিবার (৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বর্ষাকাল ঘনিয়ে আসায় শীতলক্ষ্যা নদীতে পানি বেড়েছে। তবে ক্রমশ দূষণ বাড়তে থাকায় ভরা শীতলক্ষ্যার পানিতেও উৎকট দুর্গন্ধ। ফলে জলে-স্থলে দূষণ বাড়ছে।
কল-কারখানার বর্জ্য ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অনেক এলাকায় ডাস্টবিন না থাকায় বাসা এবং মার্কেটের ময়লার স্তুপ সড়ক-মহাসড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়। সেই ময়লা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাধ্যকে কয়েক দফা স্থান বদল হলেও একপর্যায়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়েই পড়ে। ফলে বর্জ্য ও ময়লার গন্ধে পরিবেশ বিপর্যয়ের চরম হুমকিতে সিদ্ধিরগঞ্জ।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরঘেঁষে ৪১৭টি তরল বর্জ্য নির্গমনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে ৩১২টি প্রতিষ্ঠানের। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য শোধনাগার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাংরোডস্থ ডিএনডি পাম্প হাউজের তথ্যানুযায়ী, ডিএনডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) পাম্প হাউজের ৪টি পাম্পের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ৫১২ কিউসেক পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই পাম্প হাউজ থেকে কোনো প্রকার বর্জ্য শীতলক্ষ্যা নদীতে না পড়লেও এর দূষিত পানি এ নদীকে দূষণ করছে।
নদীতীরে বসবাস করা বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, শীতলক্ষ্যা নদীকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন হতে হবে। তাহলেই নদীদূষণ রোধসহ পরিবেশ রক্ষায়ও তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের স্যানিটারি বিভাগের কর্মকর্তা আলমগীর হিরণ বলেন, ‘জনবল সঙ্কটের কারণে আমরা সিটি এলাকার অনেক জায়গার ময়লা-আবর্জনা সময়মতো অপসারণ করতে পারছি না। যা কর্মী আছে, তা নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
নদী তীরঘেঁষা যে কারখানাগুলো বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই, সেগুলোতে তা স্থাপন করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ-আল মামুন।
তিনি বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা তীরবর্তী ১০৫টি শিল্প-কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার নেই। যেসব কলকারখানায় ইটিপি রয়েছে, আমরা শুধু এইসব কলকারখানাগুলোকেই অনুমোদন দিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে থাকি। এই ছাড়পত্রে আমরা কল-কারখানাগুলো পরিচালনার কিছু শর্ত দিয়ে থাকি।’
পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ-আল মামুন আরও বলেন, ‘যেসব কারখানায় ইটিপি রয়েছে, তারা তা ঠিকমতো ব্যবহার করছে কি-না সে বিষয়ে প্রতিমাসে তদারকি করা হয়। যদি কোনো কারখানা এ নিয়ম না মানে, তাহলে ওই কারখানাকে সিলগালা করা হয়। ইটিপি না থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। নদীতীরে স্থাপিত কারখানাগুলোতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।’
পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নারায়ণগঞ্জের সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘পরিবেশ দূষণ সারা বিশ্বে বিরাট একটি সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘শিল্প-কারখানায় শোধনাগার ব্যবহার না করায় ইকো সিস্টেম বা বায়ো ডাইভার্সিটি সিস্টেমগুলো (বায়ু, পানি, শব্দ) ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে বাস্তুসংস্থান বিরাজমান, সেটা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। দূষণরোধ ছাড়া এ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই।’
এএএইচ/এএসএম