রংপুরে নিরুৎসাহিত করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না তামাক চাষ
সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে সিগারেট কোম্পানিগুলোর নানামুখী প্রণোদনার কারণে রংপুর অঞ্চলে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না তামাকের উৎপাদন ও বিপণন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১০ বছরের তুলনায় এ অঞ্চলে তামাক চাষের পরিমাণ কমে আসলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এতে একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি অন্যদিকে কমে যাচ্ছে ফসলি জমির পরিমাণও।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রংপুরে ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ২২৫ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৪৩৪ হেক্টর, লালমনিরহাটে ২০ হাজার ৬০০ হেক্টর, নীলফামারীতে ৬ হাজার ৫৪০ হেক্টর, দিনাজপুরে ৪৩১ হেক্টর এবং পঞ্চগড়ে ২০ হেক্টর জমিতে তামাক উৎপাদন হয়েছিল।
২০১০-১১ সালে রংপুরে ৪ হাজার ১২৫ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১০০ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১৫ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৯ হাজার ৫৬০ হেক্টর এবং নীলফামারীতে ৫ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়।
২০১১-১২ সালে রংপুরে ২ হাজার ৫৮০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১৬৫ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৫ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৫ হাজার ১২৫ হেক্টর, নীলফামারীতে ৮ হাজার ২৮৭ হেক্টর এবং দিনাজপুরে ৩১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়।
২০১২-১৩ সালে বিভাগের ৬ জেলায় ১৭ হাজার ৮২৮ হেক্টর, ২০১৩-১৪ সালে ৬ জেলায় ১৮ হাজার ৮৬৪ হেক্টর, ২০১৮-১৯ সালে পাঁচ জেলায় কিছুটা কমে ১৩ হাজার ৭৮৭ হেক্টর জমিতে, ২০১৯-২০ সালে ১৩ হাজার ৫৫৭ হেক্টর জমিতে তামাক আবাদ হয়।
সর্বশেষ ২০২০-২১ সালে এ অঞ্চলে ১১ হাজার ৯৩২ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এরমধ্যে রংপুরে ১ হাজার ৮৬০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ২ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৭ হাজার ৪০০ হেক্টর এবং নীলফামারীতে ২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়।
রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী দোলাপাড়া গ্রামের তামাক চাষি ইসলাম উদ্দিন, কাউনিয়া উপজেলার মিজানুর রহমান, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার মতিয়ার রহমান বলেন, তারা প্রত্যেকে প্রতিবছর আলু এবং ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে ওই ফসলগুলোর দাম কম পাওয়ায় তারা চাষের খরচ তুলতে ব্যর্থ হন। তাই বিভিন্ন কোম্পানির দেয়া সার, বীজসহ আনুষঙ্গিক সহযোগিতা পাওয়ায় তারা তামাক চাষ করেন। তামাক বিক্রির কোনো ঝামেলাও থাকে না। বিড়ি-সিগারেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আগে থেকে তামাক বিক্রির চুক্তি থাকে।
তারা আরও বলেন, প্রতি দোনে (২৫ শতক) তামাক চাষে খরচ হয় সাধারণত ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং তামাক পাতা ভালো হলে ৫ মণ এবং বিষপাতা ১ মণ পাওয়া যায়।
তামাক আইন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) গত বছরের ১৫ মার্চ প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, ওই সংস্থাটির ২০১৯ সালের জুন-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক জরিপে ৮০ ভাগ সরকারি অফিসে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে, ৮৯ ভাগ অফিসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ২৭ ভাগ সরকারি অফিসে সরাসরি ধূমপান, ৮০ ভাগ অফিসে সিগারেট/বিড়ির বাট এবং ১ ভাগ সরকারি অফিসে সিগারেট/বিড়ির গন্ধ পাওয়া গেছে।
২ ভাগ সরকারি অফিসে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে এবং ৩ ভাগ অফিসে সীমানার মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে। ৭১ ভাগ অফিসের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫০ ভাগ সরকারি অফিসে পানের পিক পাওয়া গেছে।
জরিপে আরও দেখানো হয়, ৩৯ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভবনের ভেতরে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে, ৮৪ ভাগ কেন্দ্রে আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ১৬ ভাগ কেন্দ্রে ভবনের বাইরে কিন্তু সীমানার মধ্যে ধূমপান করতে দেখা গেছে। ১৫ ভাগ কেন্দ্রে সরাসরি ধূমপান, ৩১ ভাগে সিগারেট/বিড়ির বাট এবং ১২ ভাগ সেবাকেন্দ্রে সিগারেটের গন্ধ এবং ২ ভাগ কেন্দ্রে ছাইদানি পাওয়া গেছে। ৫ ভাগ সেবাকেন্দ্রে ভবনের ভেতরে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র, ৬ ভাগ কেন্দ্রে ভবনের বাইরে কিন্তু সীমানার মধ্যে তামাকের বিক্রয়কেন্দ্র এবং ৪২ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে। এছাড়া ৩৬ ভাগ সেবাকেন্দ্রে পানের পিক পাওয়া গেছে।
৭২ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে, ৯৬ ভাগ প্রতিষ্ঠানে আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৭ ভাগ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ধূমপান, ৭২ ভাগ প্রতিষ্ঠানে সিগারেট/বিড়ির বাট পাওয়া গেছে। ৭৯ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সীমানা থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
জরিপকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ধূমপানের নিদর্শনের চিত্রে দেখা গেছে,
৭৭ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়/কিন্ডারগার্টেনে, ৮১ ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, ৭৮ ভাগ কলেজে এবং ২৩ ভাগ মাদ্রাসায় ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়/কিন্ডারগার্টেনে, কলেজে এবং মাদ্রাসায় ধূমপানমুক্ত কোনো সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। তবে ১৬ ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫৯ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানের পিক পাওয়া গেছে।
এছাড়া জরিপে দেখানো হয়, ৮০ ভাগ রেস্টুরেন্টে ধূমপানের নিদর্শন পাওয়া গেছে, ৯৩ ভাগ রেস্টুরেন্টে আইন অনুযায়ী সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৪৪ ভাগ রেস্টুরেন্টে সরাসরি ধূমপান, ৭৯ ভাগ রেস্টুরেন্টে সিগারেট/বিড়ির বাট বা ছাইদানি এবং ৩ ভাগে ধূমপানের গন্ধ পাওয়া গেছে। ২৮ ভাগ রেস্টুরেন্টে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও ১২ ভাগ রেস্টুরেন্টের ভেতরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া ৫৬ ভাগ রেস্টুরেন্টে পানের পিক পাওয়া গেছে।
কেবল রংপুর শহরের মোট ৮১২টি পাবলিক প্লেসে (১৫৬টি সরকারি অফিস, ১০৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ১২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৪২১টি রেস্টুরেন্টে) পরিচালিত হয় এই জরিপ।
সংস্থাটির তথ্য মতে, তামাক মানবদেহের জন্য একটি ক্ষতিকর বিষ। তামাকজনিত ব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যা ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ১.৪ শতাংশ। তামাক এবং বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭০০০ এর বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্ষতিকর পদার্থ সরাসরি ক্যানসারে আক্রান্তে প্রভাব ফেলে। ২০১৭ সালের গ্যাটস রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যাচ্ছে।
তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ সরকারের প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তামাকের কারণে মৃত্যুর হার দেশের মোট মৃত্যুর ১৩.৫ শতাংশ
তামাক উৎপাদন বাংলাদেশে নতুন নয় বরং অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।
রংপুর উন্নয়ন সামাজিক সংস্থা ও ইন্টিগ্রেটেড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রংপুরে সিগারেটের কারখানা ৫টি ও বিড়ির কারখানা ১২১টি। এ সব কারখানার পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এ জেলায় প্রতিবন্ধীদের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।
সংস্থা দুটির তথ্য মতে, রংপুরে প্রতিবন্ধী স্কুলের সংখ্যা ৫৬টি এবং প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৪ লাখ ২ হাজার ৩৭৩, যা রংপুরবাসীর জন্য অশনি সংকেত।
রংপুরের তামাক নিয়ন্ত্রণ কোয়ালিশনের ফোকাল পারসন সুশান্ত ভৌমিক বলেন, ‘তামাক উৎপাদন ও এর ব্যবহার বন্ধ করতে হলে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। আইন অনুযায়ী নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা এবং জাতীয় বাজেটে বিড়ি-সিগারেটের ওপর সমহারে করারোপ করে কৃষকসহ সাধারণ মানুষকে সচেতন করা গেলে হয়তো এর ভয়াবহতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মাহবুবর রহমান বলেন, এ অঞ্চল হচ্ছে তামাক চাষের জন্য বিখ্যাত। তবে অতীতের তুলনায় এখন অনেকটাই কমে এসেছে এর আবাদ। তামাকের পরিবর্তে ভুট্টা, সরিষা, ধানসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, `কিছু কোম্পানির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সহায়তা করায় তামাক চাষ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু সরকারিভাবে তামাক নিষিদ্ধ করা হয়নি তাই কৃষকদের অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
এসজে