ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ১০ টাকার নোটে স্থান পাওয়া সেই মসজিদটি
ঐতিহ্য হারানোর পথে মোগল স্থাপত্যের আতিয়া মসজিদ। বাংলাদেশের ১০ টাকার নোটে এক সময় স্থান পেয়েছিল এই মসজিদের ছবি। বর্তমান সময়ও এ মসজিদের মতো ইসলামি স্থাপনা দেশে বিরল। বাংলাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলের যেসব প্রাচীন মুসলিম স্থাপনা রয়েছে তার মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
১৬০৯ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের আতিয়া গ্রামে মসজিদটি নির্মাণ করেন করটিয়ার জমিদার সাঈদ খান পন্নী। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের শাসনামলে এ মসজিদটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ।
ওিই সময় বিভাগটি কিছু কাজ করলেও হয়নি মসজিদটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার। ফলে মসজিদের বড় গম্বুজ আর দেয়ালগুলোতে দেখা দিয়েছে ফাটল। মসজিদটির রঙ কী ছিল, সেটাও বোঝার উপায় নেই। গম্বুজের ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকছে মসজিদের ভেতর। নষ্টের পথে মসজিদের পুরো অংশের পোড়ামাটি দিয়ে অলঙ্কৃত টেরাকোটা নকশাগুলোও।
সংস্কারের অভাবে আজ ধ্বংসের পথে সোয়া ৪০০ বছরের প্রাচীন ইসলামী স্থাপনার এই আতিয়া মসজিদ। এ নিয়ে চরম হতাশ মুসল্লিরা।
জানা গেছে, বিশিষ্ট সুফি সাধক শাহ্ কাশ্মীরির পরামর্শে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর তার প্রিয় ভক্ত সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগনার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ১৬০৯ সালে নির্মাণ করেন এই আতিয়া মসজিদ।
টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত মূল শিলালিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদ এলাকায় প্রাপ্ত একটি আরবি এবং একটি ফার্সি শিলালিপি রয়েছে। এগুলোতে মসজিদের নির্মাণকাল সম্পর্কিত তথ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত শিলালিপিটিতে নির্মাণকাল ১০১৯ হিজরি (১৬১০-১১ খ্রি.) দেয়া হলেও কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ওপর স্থাপিত অপর শিলালিপিতে এর নির্মাণকাল ১০১৮ হিজরি (১৬০৮-৯ খ্রি.) উল্লেখ করা হয়েছে।
সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতিতে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনায় ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরানী, ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি এ মসজিদ সংস্কার করেন। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মসজিদটির সর্বশেষ কিছু সংস্কারকাজ করে বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগ।
এক গম্বুজবিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির সামনের দিকে বারান্দার ওপর অপেক্ষাকৃত ছোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। বারান্দাসহ মসজিদটির আয়তন ১৭.৭০ মিটার এবং ১২ মিটার। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ২.২২ মিটার। মসজিদের চারকোণে অষ্টকোণী ৪টি মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে উঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে। পশ্চিম পাশের দেয়ালের অর্থাৎ কিবলা দেয়ালের মধ্যে তিনটি অলংকৃত মেহরাব আছে।
পূর্বদিকে খিলান বিশিষ্ট তিনটি প্রবেশ পথ। বারান্দা থেকে তিনটি প্রবেশ পথের মাধ্যমে মূল মসজিদে প্রবেশ করা যায়। সম্মুখ অংশসহ পুরো মসজিদই পোড়ামাটির টেরাকোটা নকশায় অলংকৃত।
স্থানীয় মুসল্লি সাদেক আলী (৫৫) বলেন, ৩০ বছর যাবৎ এ মসজিদে নামাজ আদায় করছি। অনেকেই মসজিদটি দেখতে আসেন। কিন্তু কেউই মসজিদটি সংস্কার করার কথা বলেন না। স্থানীয়দের করা একটি মসজিদ পরিচালনা কমিটি এর দায়িত্ব পালন করছেন। ওই কমিটিই বহন করছে মসজিদের ঈমাম, মুয়াজ্জিমের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ। শুধু সরকারিভাবে মসজিদের জন্য ১শ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল ফ্রি আছে। এর উপরে বিল আসলে সেটিও পরিশোধ করছে ওই কমিটি। এছাড়া সরকারিভাবে রাখা হয়েছে একজন পাহারাদার।
আতিয়া জামে মসজিদের ঈমাম ও খতিব ফরিদ আহাম্মেদ বলেন, প্রায় ১৮ বছর যাবৎ এ মসজিদে কর্মরত আছি। মসজিদটির সংস্কার দায়িত্ব পুরাতত্ত্ব বিভাগ পালন করলেও আমার কর্মরত সময়ে কোনো কাজ করেননি তারা। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ বিভাগের পক্ষ থেকে একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দেয়া আছে।
তিনি বলেন, মসজিদটি সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। সিরিয়াল না আসায় আতিয়া মসজিদের সংস্কার কাজটি করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের দাবি সংস্কারের জন্য তাদের যে সকল সাইট রয়েছে সেখানে তাদের অর্থ ও জনবল সীমিত। এছাড়াও সিরিয়াল ভিত্তিক পরিচালিত হচ্ছে তাদের ওই সংস্কার কাজ।
চলতি বছর মসজিদটি সংস্কারের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
মুঠোফোনে আতিয়া মসজিদ পরিচালনা কমিটির সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, ৪শ বছরের প্রাচীন আর ঐতিহাসিক এই আতিয়া জামে মসজিদ। প্রায় ২০ বছর যাবৎ এই মসজিদ পরিচালনা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি আমি। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই আতিয়া মসজিদ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর তাদের তত্ত্বাবধানে দুইবার মসজিদটির কিছু সংস্কার হয়। এ সময় মসজিদের দেয়ালের খসে পড়া কিছু ইট লাগানোসহ চারপাশে চুন সুড়কি দিয়ে দেয়াল পাকা করার কাজটি করেন তারা। এছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত একজন পাহারাদারকে বেতন দিচ্ছে এ বিভাগ।
তিনি আরও জানান, মসজিদের দুইটি পুকুর থেকে পাওয়া টাকা আর স্থানীয়দের মাসিক চাঁদায় ঈমাম ও মুয়াজ্জিমের বেতন দেয়াসহ চলছে আনুসাঙ্গিক খরচ। ঐতিহ্য রক্ষার্থে দ্রুত মসজিদটির সংস্কার দাবি করেন তিনি।
মুঠোফোনে বাংলাদেশ পুরাতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় বলেন, সংস্কার তালিকায় আতিয়া মসজিদের নাম আছে। সিরিয়াল অনুসারে আমাদের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আগামী বছর অর্থ বরাদ্দ পেলে ও সংস্কার প্রয়োজন আছে কিনা পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এফএ/এমএস