জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে চললেন তারা
ভারতের নাগরিকত্ব নেয়া দ্বিতীয় দফায় কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলের ৩০টি পরিবারের ১৫৭ জন ভারতে গেছেন। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা চোখের জলে ভারতগামীদের শেষ বিদায় জানান। এসময় কান্নার রোল পড়ে যায়। সৃষ্টি হয় এক বেদনাঘন পরিবেশ।
মঙ্গলবার দুপুর একটায় বাগভাণ্ডর বিজিবি ক্যাম্পের কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ৯৬২ এর ১এস এর পাশ দিয়ে নতুন এ নাগরিকদের ফুলেল শুভেচ্ছায় স্বাগত জানান।
সকাল সোয়া ৯টার দিকে ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারে পাশে শেখ ফজিলাতুন্নেছা দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গন থেকে ২৯টি পরিবারের ১৫৭ জনের দলটি ২৪টি পিকাপে মালামাল এবং পাঁচটি মিনিবাসে ভারতীয় সীমান্তের দিকে রওয়ানা দেন। পথে ভুরুঙ্গামারীর বিলুপ্ত ছিট গাড়লঝাড়া থেকে একটি পরিবারের আরও একজন যোগ দেন তাদের সঙ্গে। এসময় তাদের তদারকি করেন ভারতীয় দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অভিজিৎ রায়, ফারুক আজম ও অরূপ চক্রবর্তী।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাগভাণ্ডার সীমান্ত চেক পোস্টে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। ভারতীয় অংশে তাদের স্বাগত জানান, কুচবিহার জেলার ডিএম শ্রী পিউল গানাথন, ১০১ সাহেবগঞ্জ কোম্পানি কমান্ডার অনিন্দ ঘোষসহ সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ভারতের সাহেবগঞ্জ সীমান্তের অভ্যন্তরে তাদের এই নতুন নাগরিকদের বরণ করতে প্যান্ডেল সাজানো হয়।
বাগভাণ্ডার সীমান্তে এসব ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশের পক্ষে বিদায় অভ্যর্থনা জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম সেলিম, ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকির হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন, ভুরুঙ্গামারী ইউএনও মামুন ভূইয়া, ফুলবাড়ীর ইউএনও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, নাগেশ্বরীর ইউএনও আবু হায়াত মো. রহমত উল্লাহ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোলেহ মারফ, নবি নেওয়াজ, ওসি জিয়া লতিফ, সাবেক ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলামমোস্তফা প্রমুখ। তারা মিষ্টি খাইয়ে এবং ফুল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে ১শ ৫৮জন ভারতীয় নাগরিককে বিদায় জানান।
এর আগে প্রথম দফায় গত রোববার কুড়িগ্রামের দুটি বিলুপ্ত ছিটমহলের ১৫টি পরিবারের ৭২ জন ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যান। এ নিয়ে দু’দফায় কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে ভারতে গেছেন ২৩০ জন। এরমধ্যে দাশিয়ার ছড়া থেকে ২০৬ জন এবং ভুরুঙ্গামারীর গাড়লঝাড়ার ২৪ জন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়া ও ছোট গাড়লঝোড়ার ভারতীয় নাগরিকদের মঙ্গলবার দুপুরে ওই দেশে প্রবেশ করোনো হয়। পরে তাদের কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যান ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এসময় দু’দেশের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল মারুফ জাগো নিউজকে জানান, চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের অভ্যন্তরে ১২টিসহ বাংলাদেশে ১১১টি ছিটমহল একীভূত হয়। গত ৬-১৬ জুলাই এ জনপদগুলোতে দুই দেশের যৌথ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। যৌথ সমীক্ষায় হেড কাউন্টিং হালনাগাদ এবং অধিবাসীদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়।
এসময় কুড়িগ্রাম জেলায় অন্তর্ভুক্ত ১২টি ছিটমহলের ৩০৫ জন, লালমনিরহাট জেলায় অন্তর্ভুক্ত ৫৯টি ছিটমহলের ১৯৭ জন এবং পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ছিটমহলের ৪৮৭ জন নিয়ে মোট ৯৮৯ জন ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে সে দেশে যাওয়ার জন্য মতামত প্রদান করেন। এগার দিনব্যাপী যৌথ জনগণনা জরিপ চলাকালীন ভারত যেতে কুড়িগ্রামের তিনটি ছিটমহলের ৩০৫ জন মতামত প্রদান করেন। তাদের মধ্যে ফুলবাড়ির দাশিয়ারছড়া থেকে ৫৮টি পরিবারের ২৮১ জন এবং ভূরুঙ্গামারীর ২টি ছিটের ৫ পরিবারের ২৪ জন সদস্য।
ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য ৩০৫ জনের মধ্যে ২৮১জন ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্য থেকে দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ৭০ জন নাগরিক তাদের মত পাল্টিয়ে এ দেশে থাকতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় অন্তর্ভুক্ত ১২টি সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের জনসংখ্যা ১ হাজার ৬শ ৩০টি পরিবারে ৮ হাজার ১শ ৩২ জন। এরমধ্যে ৭৩ পরিবারের ১৪৭ জন মুসলমান এবং ১৫৮ জন হিন্দুসহ মোট ৩০৫ জন ভারতে যাওয়ার মতামত দিয়েছিলেন।
এমজেড/পিআর