অশ্রুসিক্ত চোখে গুড বাই বাংলাদেশ
রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় কুড়িগ্রাম জেলার বাগভাণ্ডার সীমান্ত দিয়ে প্রথম দফায় ভারতের ট্রাভেল পাসধারী ৭২ জন নাগরিক ভারতে প্রবেশ করেন। এরমধ্য দিয়ে তাদের দীর্ঘ দিনের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। শুরু হলো নতুন দেশের নতুন জীবন।
কেমন হবে সে জীবন? সে আশঙ্কা মেনে নিয়েই অনেক সুখ স্মৃতি রয়ে গেল বাংলাদেশে। হৃদয় ভাঙা মন আর অশ্রু চোখে অব্যক্ত উচ্চারণ `গুড বাই বাংলাদেশ`। তাদের বহন করে ২টি বাস এবং ১০টি মালামালের পিকআপ ভ্যান সরাসরি ভারতের অভ্যন্তরে যায় অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্পে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো ৬৮ বছরের বন্দিদশার এবং নিজ পছন্দের দেশে বসবাসের।
বাপ দাদার ভিটে মাটি চিরতরে ফেলে রেখে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার ১০ পরিবারের ৪৯ জন নারী পুরুষ ও শিশু কালিরহাট বাজারে জড়ো হয়ে তারা তাদের মূল ভূখণ্ড ভারতে চলে যান। সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ৪৯ জন রোববার সকালে সাড়ে ৯টায় মালামালসহ কালিরহাট বাজার থেকে বাস ও ট্রাক যোগে ভূরুঙ্গামারীর বাগভান্ডার পৌঁছান সোয়া দশটার দিকে। একইভাবে ভুরুঙ্গামারীর ছোট গাড়লঝোড়ার পাঁচ পরিবারের ২৩ জন মালামাল নিয়ে বাগভান্ডার সীমান্তে পৌঁছে।
এসময় তাদের তদারকি করেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা অভিজিৎ রায়, ফারুক আজম ও অরুপ চক্রবর্তী। বাগভাণ্ডার সীমান্তে এসব ভারতীয় নাগরিকদের বিদায় অভ্যর্থনা জানান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম সেলিম, ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকির হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন, ভুরুঙ্গামারী ইউএনও মামুন ভূইয়া, ফুলবাড়ীর ইউএনও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, নাগেশ্বরীর ইউএনও আবু হায়াত মোঃ রহমত উল্লাহ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসোলেহ মারফ, নবি নেওয়াজ, ওসি জিয়া লতিফ, সাবেক ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলামমোস্তফা প্রমুখ। তারা মিষ্টি খাইয়ে এবং ফুল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে ৭২ জন ভারতীয় নাগরিককে বিদায় জানান।
ভারতের সাহেবগঞ্জ সীমান্তের অভ্যন্তরে তাদের এই নতুন নাগরিকদের বরণ করতে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। তারাও ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নেন এই নাগরিকদের। এসময় ভারতের কুচবিহার জেলার ডিএম শ্রী পিউল গানাথন, ১০১ সাহেবগঞ্জ কোম্পানি কমান্ডার অনিন্দ ঘোষসহ সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সীমান্তবর্তী পূর্ব সাহেবগঞ্জের সাধাণি মানুষ হাত নেড়ে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান। চোখের জলে বিদায় হলেও হাসি মুখে বরণ অনুষ্ঠান বেদনা ভুলতে সহায়ক হবে বলে সবার ধারনা।
আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ৯৬২ এর ১ এস এর পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় সীমান্তবর্তী শত শত বাংলাদেশি নারী-পুরুষ হাত নেড়ে বিদায় জানান তাদের। ভারতীয় নাগরিকদের বিদায় জানাতে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সাংসদ মো. জাফর আলী। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম মঞ্জু মণ্ডল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান মণ্ডল, ভুরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোকন চৌধুরী, অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু, এম এ চাষী করিম প্রমুখ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার এমএলএ রবীন্দ্রনাথ ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, বঞ্চিত ৬৮ বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া এসব মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা সাবেক ছিটমহল থেকে যারা ভারতে আসছেন তাদেরকে গ্রহণ করা শেষে তাদের জন্য বরাদ্দে থাকা ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়াও ইতোমধ্যে যারা ভারতে প্রবেশ করেছেন তাদের সন্তানদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছে। দুদেশের সরকার এবং প্রধানদের আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি তারা এই অর্ধ লক্ষাধিকের বেশি মানুষের ৬৮ বছরের গ্লানি দূর করেছেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম সেলিম জাগো নিউজকে জানান, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়া ও ছোট গাড়লঝাড়ার ভারতীয় নাগরিকদের দুপুর দেড়টার দিকে ওই দেশে প্রবেশ করোনো হয়। পরে তাদের কুচবিহার জেলার সাহেবগঞ্জের অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যান ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এসময় দুদেশের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রোববার সকালে দেশের সবচয়ে বড় বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যারা ভারতে যাচ্ছেন না তাদেরকে ঘিরে শান্তনা দেয়া হচ্ছে। বিদায় বেলায় তাদের কান্নায় যেন আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যারা ভারতে যাচ্ছেন তাদের এপারে রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনরা বিদায় জানাতে এসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। অনেকে জানালেন, আমাদের মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে যাওয়ার কথা ছিল না। লোভ দেখিয়ে আমাদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। তারপরও যাচ্ছি আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন। মনের মধ্যে নানা আশঙ্কা কাজ করছে।
ছিটমহল বিনিময় বিরোধি সংগঠন ইউনাইটেড কাউন্সিলের সভাপতি মিজানুর রহমান প্রথম দিনই ভারতে যান। কিন্তু তার স্ত্রী মোমেনা ও দুই মেয়ে তার সঙ্গে যায়নি। এ নিয়ে হতাশা থাকলেও চেহারায় তার প্রকাশ নেই। বরং তিনি উচ্চস্বরে সবাইকে কান্নাকাটি না করতে বলেন।
তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, বিভিন্ন মিডিয়ায় এ কান্নার চিত্র প্রকাশ হলে, সবাই ভাববে জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রতিপক্ষরা কটুক্তি করার সুযোগ পাবে। রোববার ১০টি পরিবারের ৪৯ জন দাশিয়ারছড়া থেকে এবং ভুরুঙ্গামারীর ছোট গাড়ল ঝাড়া থেকে পাঁচটি পরিবারের ২৩ নারী পুরুষ ও শিশু তাদের মূল ভূখণ্ডে চলে যান।
ভুরুঙ্গামারীর ইউএনও মামুন ভূইয়া জাগো নিউজকে জানান, যারা দাশিয়ারছড়া থেকে তাদের মূল ভূখণ্ড ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন তাদের বরণ করে নিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওপারের সাহেবগঞ্জে বিভিন্ন রঙিন সাজে সাজিয়ে রেখেছে। ইমিগ্রেশন শেষে দিনের মধ্যেই একে একে সবাইকে ভারতের অভ্যন্তরে অস্থায়ী ক্যাম্পে নেয়া হয়।
জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল মারুফ জাগো নিউজকে জানান, চলতি বছরের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের অভ্যন্তরে ১২টিসহ বাংলাদেশে ১১১টি ছিটমহল একীভূত হয়। গত ৬-১৬ জুলাই এ জনপদগুলোতে দুই দেশের যৌথ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। যৌথ সমীক্ষায় হেড কাউন্টিং হালনাগাদ এবং অধিবাসীদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়। এসময় কুড়িগ্রাম জেলায় অন্তর্ভুক্ত ১২টি ছিটমহলের ৩০৫ জন, লালমনিরহাট জেলায় অন্তর্ভুক্ত ৫৯টি ছিটমহলের ১৯৭ জন এবং পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ছিটমহলের ৪৮৭ জন নিয়ে মোট ৯৮৯ জন ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে সে দেশে যাওয়ার জন্য মতামত প্রদান করেন।
১১ দিনব্যাপী যৌথ জনগণনা জরিপ চলাকালীন ভারত যেতে কুড়িগ্রামের তিনটি ছিটমহলের ৩০৫ জন মতামত প্রদান করেন। তাদের মধ্যে ফুলবাড়ির দাশিয়ারছড়া থেকে ৫৮টি পরিবারের ২৮১ জন এবং ভূরুঙ্গামারীর ২টি ছিটের ছয় পরিবারের ২৪ জন সদস্য। ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য ৩০৫ জনের মধ্যে ২৮১ জন ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করেছেন। তাদের মধ্য থেকে দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ৭০ জন নাগরিক তাদের মত পাল্টিয়ে এ দেশে থাকতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেছেন।
তিনি আরো বলেন, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় অন্তর্ভুক্ত ১২টি সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের জনসংখ্যা এক হাজার ৬৩০টি পরিবারে ৮ হাজার ১৩২ জন। এর মধ্যে ৭৩ পরিবারের ১৪৭ জন মুসলমান এবং ১৫৮ জন হিন্দুসহ মোট ৩০৫ জন ভারতে যাওয়ার মতামত দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৯ পরিবারের ৭০ জন এখন আর ভারতে যেতে চাচ্ছেন না। তাদের অধিকাংশই হিন্দু পরিবার।
কুড়িগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলের যারা ভারত যেতে চান তাদের ৩ দফায় ভূরুঙ্গামারী বাগভাণ্ডার ও ভারতের সাহেবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কুড়িগ্রামে প্রথম দফায় আগামী ২২ নভেম্বর দাশিয়ারছড়ার ১০টি পরিবারের ৪৯ জন এবং ভুরুঙ্গামারীর ৫ পরিবারের ২৩ জন, ২য় দফা ২৪ নভেম্বর দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ১১৫ জন এবং ২৬ নভেম্বর বাকিদের নিয়ে যাওয়া হবে। কেউ যদি কোনো কারণে উল্লেখিত তারিখে যেতে না পারেন তাদের জন্য ২৯ নভেম্বর রিজার্ভ ডে রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জাগো নিউজকে জানান, ট্রাভেল পাস প্রাপ্তদের ভারতে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি ছাড়াও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু যারা এখন ভারতে যেতে চায় না তাদের ব্যাপারে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে নির্দেশনা রয়েছে কাউকে ভারতে যেতে বাধ্য করা হবে না। এ অর্থে ভারতের ট্রাভেল পাসধারীরা ভারতে যেতে না চাইলে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারবেন।
এমজেড/পিআর