হাসপাতাল নয় যেন কসাইখানা!
চাঁদপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসাপাতালে জনবল সঙ্কট, মান্ধাতার আমলের এক্স-রে মেশিন ও লক্কর-ঝক্কর অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে চিকিৎসা সেবা চলছে। এছাড়া চরাঞ্চলের রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি আট বছরেও চালু না হওয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। তিনতলা বিশিষ্ট সংক্রামকব্যাধি ওয়ার্ডটিও ১০ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। যার জন্য চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তারসহ অন্যান্যরা। আর প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গরীব সাধারণ রোগীরা।
২৫০শয্যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জাগো নিউজকে জানান, জনবল সঙ্কটের কারণে হাসপাতালের চতুর্থ তলায় কেবিন ব্লক এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদ রয়েছে ২৮৮টি। এর মধ্যে পদ শুন্য আছে ৬৬টি। হাসপাতালের শুন্য পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া) পদ, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ডেন্টাল) পদ, আবাসিক মেডিকেল অফিসার পদ ২ জন, অ্যানেসথেটিস্ট পদ, সহকারী রেজিস্ট্রার/সহকারী সার্জন পদ চারজন, মেডিকেল অফিসার বিষয় ভিত্তিক পদ পাঁচটি, মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদী/ ইউনানী/ হোমিও) পদ, সেবা তত্ত্বাবধায়ক পদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদ, উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক পদ, সিনিয়র স্টাফ নার্স ৪০ জন, সহকারী সেবক/সেবিকা পদ একটি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফিজিও) পদ, কম্পিউটার অপারেটর পদ, ক্যাসিয়ার পদ, স্টুয়ার্ড পদ, অফিস সহকারী কাম ডাটা অপারেটর পদ, সহকারী হিসাব রক্ষক পদ শুন্য রয়েছে।
হাসপাতালের এক্স-রে বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি) নাজির আহমেদ জাগো নিউজকে জানান, মান্ধাতার আমলের এক্স-রে মেশিন গিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ১৯৮৪-৮৫ সালে প্রাপ্ত এক্স-রে মেশিন দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্য সেবা। যদিও এ মেশিনটি মেরামত অযোগ্য। বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রায় সব বৃহৎ হাসপাতালগুলোতে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন স্থাপন করা হচ্ছে। অথচ চাঁদপুরের ২৫০ শয্যা হাসপাতাল চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও শরীয়তপুরে তিনটি জেলার সাধারণ জনগণের সেবা দিয়ে আসছে। এখানে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন দেয়া হয়নি। এজন্য মান্ধাতার আমলের এক্স-রে মেশিন দিয়ে নাম মাত্র সেবা দিতে হচ্ছে রোগীদের। তাও আবার মাঝে মধ্যে নষ্ট থাকে।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের ডা. মাইনুল ইসলাম মজুমদার জাগো নিউজকে জানান, হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের অবস্থাও নাজুক। আধুনিক যন্ত্রাংশের অভাবে অপারেশনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে হাসপাতালে আগত অপারেশনের রোগীরা স্বাস্থ্য সেবা সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। তারপরও আমরা এ যন্ত্রাংশ দিয়ে পর্যাপ্ত অপারেশন করে যাচ্ছি।
চাঁদপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার মো. মফিজ জাগো নিউজকে জানান, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকার কথা। কিন্তু আছে দুটি। তাও আবার লক্কর-ঝক্কর মার্কা। ২০০৩ সালের প্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সটি (ছ-১১-০০০৬) এখন জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে চলছে। প্রায়ই পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। ট্রাক্টর বা কোনো মাধ্যম দিয়ে টেনে এনে মেরামত করতে হয়। এক কথায় বিকল অবস্থা। আর ২০০৯ সালে প্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সটিও (ছ-১১-০০০৮) অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এটিও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়।
হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. সফিউল্যা জাগো নিউজকে জানান, চাঁদপুর ২৫০ শয্যা সরকারি জেনারেল হাসপাতালের নৌ-অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘ আট বছরেও চালু করা সম্ভব হয়নি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের আঙিনায় অ্যাম্বুলেন্সটি খোলা আকাশের নিচে আট বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। চালকের পদ সৃষ্টি ও জালানি তেলের বরাদ্দ না থাকায় লাখ লাখ টাকার অ্যাম্বুলেন্সটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরং নতুন করে আরো একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বরাদ্দপত্র এসেছে এ হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এতে হতবাক হয়ে নতুন বরাদ্দের অ্যাম্বুলেন্সটি না দেয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছে।
চাঁদপুরের ১৩টি চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৮সালে ২৫০শয্যা সদর হাসপাতালে একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চালকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি এবং পদায়ন করা হয়নি। বরং স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে গত বছরের ২৩ অক্টোবর আরও একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বরাদ্দ দিয়েছে। যেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স দীর্ঘ আট বছর চালকের অভাবে পড়ে থেকে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়ে আছে। এ অবস্থায় আরো একটি নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের বরাদ্দ দেয়ার কোনো যুক্তিকতা নেই।
এ হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডের তিনতলা ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে ভবনের ৯৮% কাজ শেষ হলেও বর্তমানে অর্থাভাবে বাকি ২% কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থা গত ১০বছর ধরে চলছে। তবে একতলা ভবনের ঊর্ধ্বমুখী দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলা পাঁচ বছর যাবত পড়ে আছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রকৌশলী বিভাগ চাঁদপুরের সহকারী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে জানান, সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ড নির্মাণের পূর্ণাঙ্গ তথ্য আমাদের জানা নেই। একতলা ভবন হওয়ার পর এটি হাসপাতালকে হস্তান্তর করা হয়েছিল। পরে আবার ঊর্ধ্বমুখী কাজের জন্য ভবনটি আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৌশলী বিভাগকে দেওয়া হয়। এটুকুই আমাদের জানা আছে।
সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ঊর্ধ্বমুখী ভবন নির্মাণ কাজ ২০১০-১১ অর্থ বছরে শুরু হয়। কুমিল্লার ঠিকাদার ওয়ালী উল্যা ভূঁইয়া এ কাজ পান। তবে তিনিও কাজটি সাব-কন্ট্রাক্টর দিয়ে করিয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৬শ ৫৪ টাকা। ভবন নির্মাণ কাজ ৯৮% সমাপ্ত হয়েছে। বাকি ২% এসি, ফ্যান লাগানোর কাজ রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ নেই, তাই ঠিকাদার কাজ করছে না।
এদিকে কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, সেই তথ্য কেউ দিতে পারেনি। তাহলে কি ভবনটি এভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকবে। যদিও ইতোমধ্যে ভবনের নির্মাণ কাজের বিভিন্ন স্থান খসে পড়ছে। বিষয়টি ২৫০শয্যা হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখলে হয়তোবা দ্রুত ভবনটির কাজ শেষ করে হস্তান্তর হতে পারে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নূরুল কবির, আব্বাস মিয়া, গোফরান হোসেন, আছিয়া খাতুন, আম্বিয়া বেগম জাগো নিউজকে জানান, এটাতো হাসপাতাল নয়, যেন কসাই খানা। যেখানেই যাই, টাকা ছাড়া কোনো চিকিৎসা নাই। অভিযোগ দিলেও বিপদ। তাদের লোকজন মাইরধর করে। তাইলে বুঝেন কেমন চিকিৎসা দেয়। এমন হাজারো অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের কার্য চলাকালীন ডাক্তাররা থাকেন না। নিজেরা চেম্বারে রোগী দেখেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. প্রদীপ কুমার দত্ত জাগো নিউজকে জানান, রোগীদের এসব অভিযোগ সত্য নয়। তারা মনগড়া অভিযোগ দিচ্ছেন। অথচ লোকবল ছাড়াই ২৫০ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। যার জন্য রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ডাক্তারসহ অন্যান্যদের।
তারপরও রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। শুন্য পদের অনুকূলে লোক নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ তলার কেবিন সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব কেবিন অতিরিক্ত। ২৫০ শয্যা হাসপাতালের জন্য যতগুলো কেবিন ও ওয়ার্ড প্রয়োজন তা এখন বিদ্যমান রয়েছে।
তিনি বলেন, একটি নতুন অ্যাম্বুলেন্স জরুরি ভিত্তিতে দরকার। এছাড়া ড্রাইভারের পদ সৃষ্টি করা দরকার। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লেখা হয়েছে। কিন্তু এখনো বরাদ্দ ও পদ সৃষ্টির অনুমোদন পাওয়া যায়নি। এছাড়া একটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজও বরাদ্দ মেলেনি। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের জন্য ইতোমধ্যে কার্ডিয়াক মনিটর চারটি, বায়োকেমিস্টি এনালাইজার একটি ও বায়োগ্যাস এনালাইজার একটি বরাদ্দ চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এমজেড/এমএস