একটি ঘর ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই ভিক্ষুক জয়নবের
মা মারা যাওয়ার পর, বাবা আবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে আশ্রয় মেলেনি চার সন্তানদের। অসহায় দাদি জয়নব ভানুই এখন তাদের একমাত্র সহায়।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ আলী মোল্লা কান্দি গ্রামের জাকির হোসেন মালের বাড়িতে ২০ বছর যাবত বসবাস করছেন জয়নব ভানু (৬৮)। মঙ্গলবার (২ মার্চ) দুপুরে কথা হয় জয়নব ভানুর সঙ্গে।
তিনি জানান, স্বামীর নাম শরীফ আলী ব্যাপারী। স্বামীকে নিয়ে তিনি চাঁদপুর জেলার রাজ রাজারশ্বর এলাকায় নিজ বাড়িতে থাকতেন। সুখের সংসার ছিল তার। সুখের সংসারে জন্ম নেয় এক ছেলে। নাম বিল্লাল হোসেন ব্যাপারী। কিন্তু হঠাৎ নদী ভাঙন শুরু হলে তাদের বাড়ি ঘর নদীগর্ভে বীলিন হয়ে যায়। সব হারিয়ে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে আশ্রয় নেন শরীয়তপুরের দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নে।
কয়েক বছর পর তার স্বামী শরীফ আলী আরেকটি বিয়ে করে গায়েব হয়ে যান। সেই থেকে ছেলে বিল্লালকে নিয়ে মোহাম্মদ আলী মোল্লা কান্দি গ্রামের জাকির হোসেন মালের জমিতে একটি জরাজীর্ণ দোচালা ঘরে বসবাস করে আসছেন তিনি। অন্যের বাড়িতে থেকে সন্তানকে মানুষ করতে ও দু’মুঠো খেতে ভিক্ষা শুরু করেন জয়নব।
এরই মধ্যে বিয়ে করেন জয়নবের ছেলে বিল্লাল। বিল্লালের দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে ইয়াসিন ব্যাপারী (১৮) শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোট ছেলে রিপন ব্যাপারী (১৬) পুষ্টিজনিত কারণে বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকে। মেয়ে আমেনা আক্তার (১৩) ও রমনা (১১)। ছোট ছোট রেখে তাদের মা মারা যান। আর বাবা বিল্লাল আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান।
তারপর থেকে ৮ বছর যাবত তারা দাদি জয়নব ভানুর কাছেই থাকে। ভিক্ষাবৃত্তি করেই চার নাতি-নাতনি জীবন চলছে তার।
কিন্তু গত বছর ঝড়ে সেই দোচালা ঘরটিও ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। ভিক্ষা করে নাতি-নাতনিদের নিয়ে দিনে ভাঙা ঘরটিতে থাকেন জয়নব। রাত হলে দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হযরত রকমান সরদারের বাড়িতে থাকেন।
জয়নব ভানু এখন বয়সের ভারে নিজেও অসুস্থ। দীর্ঘদিন ধরে শরীর ব্যথায় ভুগছেন। তারপরও নাতি-নাতিদের নিয়ে সারাদিন ভিক্ষা করেন। দিনে একবার রান্না করে নিজে খান, নাতি-নাতনিদের খাওয়ান।
দুঃখ করে তিনি বলেন, ‘পোলায় মোর খোঁজ-খবর নেয় না। চাইরডা পোলাপান থুইয়া আরকটা বিয়া কইরা গেছেগা। তাই নাতি-নাতনিগো নিয়া ভিখা কইরা খাই। ঘর ভাইংগা গেছে। ঘর নাই, দুয়ার নাই, শুইতেও পারি না। হাডে যাই, বাজারো যাই ভিখা কইরা ছডাক চাইলও পাই না। রাইতে নাতি-নাতনিগো নিয়া রাইনদা খাই। মাইনসের বাড়ি বাড়ি থাহি। কেই সাহায্য করে না।
অনেক কষ্টের জীবন আমাগো।’
তিনি বলেন, ‘একটু জায়গা জমির আশায় ভিক্ষা করি। আর আমার কিছু চাওয়ার নাই। একটু জমি, ঘর পাইলে অনেক উপকার হইত।’
ওই গ্রামের অনেকেই বলেন, অনেক বছর যাবত ভিক্ষা করে নাতি-নাতনিদের খাওয়ান জয়নব। নাতি একজন প্রতিবন্ধী, আরেকজন অসুস্থ থাকে। অন্যের বাড়িতে থাকে তারা। যে ঘরটিতে থাকত, তাও ঝড়ে ভেঙে গেছে। ঘর নাই, জমিও নাই তার। বড় কষ্টের জীবন। সরকারের পক্ষ থেকে জয়নবকে যদি জমি ও একটি ঘর দিত, তাহলে শেষ বয়সে এসে একটু সুখ পেত।
এ বিষয়ে দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হানিফ শেখ জানান, জয়নব ভানুর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সম্প্রতি সমাজসেবা থেকে জয়নব বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। তবুও জয়নবের জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়েছেন তিনি। এসব কাগজপত্র পেলে সরকারের নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনার পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি।
জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ফয়জুল বারী বলেন, সমাজসেবা অধিদফতর সমাজের অসহায়, এতিম, প্রতিবন্ধী এবং ভিক্ষুকদের নিয়ে কাজ করে। জানতে পারলাম দক্ষিণ তারাবুনিয়া ইউনিয়নে জয়নব ভানু নাকি ভিক্ষা করে জীবনধারণ করছেন। তাকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। তার এক নাতি প্রতিবন্ধী। তিনি যদি জরিপকৃত প্রতিবন্ধীর আওতাভুক্ত হন, তাহলে তাকে ভাতার আওতায় আনা হবে। এছাড়া ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য সমাজসেবার ফান্ড রয়েছে এবং উপজেলা ভিত্তিক কমিটি রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনার জন্য সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নাম তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর-আল-নাসীফ বলেন, জানতে পারলাম জয়নব ভানুর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ও থাকার জায়গা নেই। তিনি যদি আমাদের কোনো সামাজিকবেষ্টনীতে থাকেন বা নাও থাকেন আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।
আর তার যদি ঘর ও জমি না থাকে তাহলে মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রধানমন্ত্রী যে ঘর দিচ্ছেন সেটি দেয়ার চেষ্টা করব। সেটি না হলে আমাদের বেসরকারি কিছু ঘর আছে যে কোনো একটি ঘর দিয়ে তার আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন তিনি।
ছগির হোসেন/এফএ/জেআইএম