থেমে যাননি নিপুন হিজড়া
নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে সমাজে টিকে থাকার অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। ঘরে-বাইরে কোথাও ঠাঁই নেই তাদের। সমাজে এখনও নানাভাবে বিড়ম্বনা এবং বৈষম্যের শিকার তারা।
সমাজ-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের সামাজিক সম্মান, শিক্ষা, কর্ম ও বাসস্থানের অধিকার দেয়া হয় না। হিজড়া মানেই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করা, হিজড়া মানেই বাড়িতে নেচে-গেয়ে টাকা তোলা।
তবে চিরচারিত এসব ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে দিন বদলের গল্প লিখেছেন রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ৮নং পৌর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিপুন হিজড়া। মা-বাবার দেয়া নাম আরিফুল ইসলাম আরিফ হলেও তিনি নিপুন নামেই সকলের কাছে পরিচিত।
হিজড়াদের একটা বড় অংশ যখন ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে দিনাতিপাত করছেন, নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন ঠিক তখন উদ্যোক্তা হয়ে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখেছেন এই নিপুন। বলা চলে সফলও হয়েছেন তিনি। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এই নিপুনের গল্পটাও তাই ভিন্ন।
জন্মের পাঁচ বছর বয়সেই ক্ষুদ্র বস্ত্র ব্যবসায়ী বাবা আবু আল মনুসর মারা যান। বড় ভাই-বোন ও তাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা রমিজা বেগম। অন্যের বাড়িতে, হোটেলে কাজ করে সংসারের হাল ধরেন রমিজা ও তার সন্তানরা। এভাবে বেড় উঠতে উঠতে নিপুন বুঝতে পারেন তিনি আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো না। তবে এতে হতাশ না হয়ে নিপুনও বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না করে তাকে সহায়তায় এগিয়ে আসেন অন্য সদস্যরাও।
নিপুন জানান, পীরগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালের এসএসসি পাসের পর শাহ আব্দুর রউফ ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করতেন মানুষের বাড়িতে, হোটেলে। পড়াতেন শিক্ষার্থীদের। তবে ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি-বেসরকারি চাকরি।
একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) মাঠকর্মীর চাকরি হলেও তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় জানার পর তাকে বাদ দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে ওই এনজিওতে মাত্র ৯শ’ টাকা মাসিক বেতনে বাবুর্চির কাজ নেন তিনি। এভাবে দিন চললেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না তার।
এদিকে বড় বোনের বিয়ে হয়। বড় ভাইও বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পাঁচ শতক বসতভিটা ছাড়া আর কোনো সহায়-সম্বল ছিল না। মা ও দত্তক নেয়া এক সন্তানকে নিয়ে সুখের নীড় রচনার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
নিপুন জানান, ২০১৫ সালে রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে জেন্টস পার্লারের ওপর ৫০ দিনের একটা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। অন্য হিজড়াদের মতো মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি না করে নিজে কিছু করার ইচ্ছা থেকে ওই বছরই পীরগঞ্জের একটি অভিজাত শপিংমলে দোকান ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পীরগঞ্জ জেন্টস পার্লার’। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পীরগঞ্জ চাইনিজ ফাস্ট ফুড’ নামে আরও একটি দোকান। প্রতিমাসে যা আয় হয় তা দিয়ে মা ও দত্তক নেয়া সন্তানকে নিয়ে ভালোই চলে।
পাশাপাশি প্রতি তিন মাস পরপর সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত এমন অবেহেলিত ১শ’ মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করেন।
করোনাকালে ব্যবসায় ভাটা পড়লেও হাল ছাড়েননি তিনি। সাড়ে ১৩ হাজার টাকা করে মাসিক বেতনে তিনজন কর্মচারী তার পার্লারে কাজ করছেন। তার দোকানের অধিকাংশ গ্রাহক শিক্ষার্থী। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় নিজ বাড়িতে পার্লারের কাজ শুরু করেন তিনি। ব্যবসায় মন্দার কারণে অন্যদের আর্থিক সহায়তা আপাতত বন্ধ থাকলেও পুনরায় শুরুর কথাও ভাবছেন তিনি।
নিপুন বলেন, অন্যের ওপর নির্ভর করে নয়, আমি চাই আমার মতো করে নিজের পায়ে যেন সকলেই দাঁড়ায়। সমাজে হিজড়াদের নিয়ে মানুষ নানা রকম কটু কথা বলে। অন্যের কাছে হাত না পেতে নিজ উদ্যোগে কিছু করা গেলে সমাজের মানুষজনও সাধুবাদ জানাবে।
নিপুনের মা রমিজা বেগম বলেন, সকলের দোয়ায় নিপুন নিজ উদ্যোগে সাবলম্বী হয়েছে। অন্য হিজড়াদের মতো মানুষের দ্বারে দ্বারে সে ভিক্ষা করেনি। তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না করে তার পাশেই ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে। তার একাগ্রতা ও চেষ্টায় সুখেই দিন কাটছে আমাদের।
হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নের অনুকরণীয় উদাহরণ নিপুন। তারমতো করে অন্যরাও উদ্যোগী হলে হিজড়াদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পাল্টে যাবে বলে মনে করেন পীরগঞ্জ পৌরসভার ৮নং পৌর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুর রহমান শফি।
তিনি বলেন, নিপুন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সামাজিকভাবে সবার সাথে সে মিলেমিশে থাকে। সবার কাছেই সে স্নেহ ও ভালোবাসা পায়। পৌরসভা থেকে তাকে সহায়তার চেষ্টা করা হয়। তাকে অনুকরণ করে অন্যদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
পীরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি কাউকেই পেছনে ফেলে রেখে না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা উচিত। এই প্রতিকূল পরিবেশকে উপক্ষো করে নিপুনের মতো যারা উদ্যোমী হয়ে উঠছেন তারাও আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নানা কাজে দক্ষ হয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। আর এসব উদাহরণের কারণে তাদের প্রতি সমাজের মানুষদের মনোভাবও পরিবর্তন হচ্ছে। নিপুনের মতো এমন উদাহরণ সৃষ্টির জন্য কাজ করছে বর্তমান সরকার।
জিতু কবীর/এফএ/এএসএম