ঘটকালি পেশায় দুর্দিন
একটা সময় ছিল, সন্তানদের বিয়ের বয়স হলেই ঘটকদের দ্বারস্থ হতেন বাবা-মা। অর্থাৎ বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ঘটক। তবে যুগ পাল্টেছে। সময়ের পরিক্রমায় জৌলুস হারিয়েছে ঘটকি পেশা।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার এনায়েতনগর বাসিন্দা আব্দুর রহিম। ৭০ বছরের জীবনে ঘটকালি করেছেন ২২ বছর। ৬০০টিরও বেশি বিয়ে দিয়েছেন।
ছয় সন্তানের জনক আব্দুর রহিম আগে স্বর্ণের ব্যবসা করতেন। সন্তানদের ব্যবসা বুঝিয়ে দিয়ে এক পর্যায়ে শখের বসে ঘটকালি শুরু করেন। শুরুতে আনন্দের সঙ্গে ঘটকালি করেছেন। কিন্তু আগের মতো রোজগার না থাকায় এখন পেশায় বিরক্তি এসেছে তার।
আব্দুর রহিম বলেন, আগে মাসে চার-পাঁচটা বিয়ে দিতাম। এখন ছয় মাসেও একটা বিয়ে দিতে পারি না। আমার কাছে পাত্র-পাত্রী পক্ষ ফোন নম্বর নিয়ে নিজেরাই বিয়ের কার্যক্রম সেরে নেয়।
তিনি আরও বলেন, ঘটকরা একটা আশা নিয়ে দু’পক্ষের জন্য দূর-দূরান্তে যাই, টাকা-পয়সা খরচ করি। কিন্তু কোনোরকম ফোন নম্বর পেলেই তারা (পাত্র-পাত্রী পক্ষ) আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাসিন্দা মুজিবর রহমান (৪৫)। দীর্ঘ ২৭ বছর বসবাস করে আসছেন সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকায়। এক বন্ধু ও বন্ধুর প্রেমিকার পরিবারের মধ্যকার সমঝোতায় বিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই ঘটকালি তার শুরু। ১৫ বছর ধরে ঘটকালি করেই মুজিবর রহমানের সংসার চলে। এ পর্যন্ত ৪০০টিরও বেশি বিয়ে দিয়েছেন। তবে প্রযুক্তির কারণে বিভিন্ন সময় প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ঘটকরা খুব পরিশ্রম করে। অনেক সময় দেখা গেছে পাত্র বিকেল ৩টায় আসবে বলে সময় দিয়েছে। কিন্তু আসে বিকেল ৫টায়। কোনোরকম ফোন নম্বর নিতে পারলেই আমাদের আর মূল্যায়ন থাকে না। এরপর পাত্র বা পাত্রী পক্ষ বলে দেয় তারা এ বিয়ে দেবে না। কিন্তু দুই মাস পর খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আমার মাধ্যমে যোগাযোগ হওয়া তাদের বিয়ে হয়েছে।
তিনি যোগ করেন, আমরা এ ধরনের প্রতারণার বিচারও পাই না। আবার কেউ কেউ বিয়ে হওয়ার পর টাকা দেবে বলে মাসের পর মাস হয়রানি করে।
৬৮ বছর বয়সী রহিমা বেগম বাস করেন উপজেলার চিত্তরঞ্জন এলাকায়। একযুগেরও বেশি সময় ধরে ঘটকালি করছেন। তিনি বলেন, পাত্র-পাত্রীদের বাড়ি যাই। আমার মাধ্যমে তারা ফোন নম্বর নেয়। এরপর ২০-৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দেয়। কিছুদিন পর দেখি তাদের বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার প্রাপ্য সম্মানী পাই না।
তার জানা মতে, সিদ্ধিরগঞ্জে এখন হাতেগোনা ৮-৯ জন ঘটকালি পেশায় নিয়োজিত। আরও অনেকেই আছেন, যারা ঘটকালির পাশাপাশি অন্য পেশায় জড়িত। কারণ, বর্তমান যুগে এ পেশায় আয় রোজগার নেই বললেই চলে।
সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিলের সোহানা ম্যারেজ মিডিয়ার স্বত্বাধিকারী সোহানা বলেন, ম্যারেজ মিডিয়ায় পাত্র-পাত্রীরা বায়োডাটা ও ছবি দিয়ে গেলে দু’পক্ষের মধ্যকার পরিচয়টা কিন্তু আমাদের মাধ্যমে হয়। অথচ পরিচয় হলে আমাদের না জানিয়ে বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে। প্রায়ই আমরা এ ধরনের প্রতারণার শিকার হই।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জস্থ ১নং ওয়ার্ডের মুসলিম নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার মো. আশরাফ উদ্দীন বলেন, এক সময় বিয়েতে ঘটকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু বর্তমানে ঘটকের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায় না। অনেক সময় দেখা যায় পাত্র-পাত্রী নিজরাই বিয়ের জন্য চলে আসে। বাবা-মা আর ঘটক তো দূরের ব্যাপার, একটা সাক্ষীও পর্যন্ত নিয়ে আসে না।
এসকে শাওন/এসজে/এমকেএইচ