জমানো টাকায় ভাষার প্রতি শিশুদের ভালোবাসা
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই গ্রামের শিশুদের মাঝে এক অন্যরকম আমেজ তৈরি হয়েছে। কয়েকটি বাড়ি ঘুরে কলাগাছ সংগ্রহ শেষে নিজেদের জমানো টাকায় বাকি উপকরণ ক্রয় করে গড়ে তুলেছে অস্থায়ী মিনার। রঙিন কাগজে মুড়িয়ে কলাগাছের মাথায় লাগানো হয়েছে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। পাটের সুতলি ও আঠা দিয়ে আটকে দেয়া হয় রঙিন কাগজগুলো। এতেই তৈরি হয় ভাষার প্রতি ক্ষুদে শিশুদের ভালোবাসার এক পরিবেশ।
গাজীপুরের শ্রীপুরে অজপাড়াগাঁ মাওনা ইউনিয়নের আক্তাপাড়া গ্রামে শিশুদের এই উৎসব ঘিরে এলাকায় এখন ভাষা দিবসের আমেজ। কলাগাছ ও রঙিন কাগজে তৈরি শহীদ মিনারের প্রতিকৃতিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে তাদের এ পরিশ্রমের প্রহর শেষ হবে।
ক্ষুদে শিশুদের ভাষার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নিজেদের হাতে ও শ্রমে এভাবেই তৈরি করা অস্থায়ী শহীদ বেদিকে ঘিরে। তাদের তৈরি করা এ বেদিতে ভাষা শহীদদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন, নিজেদের কণ্ঠে ও মাইকে ভাষার গান বাজানোসহ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান পালন হবে এবারও। এতে ক্ষুদে শিশুদের সঙ্গে প্রতিবারই যোগ দেন গাঁয়ের বয়স্ক নারী ও পুরুষরাও।
স্থানীয়রা জানান, আক্তাপাড়া গ্রামে কোনো স্থায়ী শহীদ মিনার নেই। বেশ কয়েকবছর ধরেই গাঁয়ের শিশুরা ভাষা দিবসকে সামনে রেখে কলাগাছ দিয়ে তৈরি করা শহীদ মিনারের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছে। আক্তাপাড়া গ্রামে স্থানীয় সোনা মিয়ার জমিতে তারা শহীদ বেদি তৈরি করেন।
প্রতিবছরের মতো এবারও গাঁয়ের ১৭জন শিশু নিজেদের জমানো ও অভিভাবকদের টাকায় ভাষা দিবসের আয়োজন করেছে। শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালেই তারা সব প্রস্তুতি শেষ করেছে।
স্থানীয় রেইনবো কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী নয়ন মাহমুদ জানায়, এ গাঁয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্থানীয় এই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তবে আক্ষেপের বিষয় তাদের বিদ্যালয়ে কোনো শহীদ বেদি নেই। তাই এই গাঁয়ের শিশু ও কিশোররা মিলে প্রতিবছরই অস্থায়ী কলাগাছ দিয়ে তৈরি বেদিতেই ভাষা দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ অনুষ্ঠান ঘিরে তাদের কিছু ব্যয় হয় তা নির্বাহে তারা সারাবছর ধরেই কিছু টাকা সঞ্চয় করে। এবারও তারা ১৭ জন মিলে খরচের টাকা জোগাড় করে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
তাদের পাশাপাশি এই গ্রামে এমন ধরনের আরও কয়েকটি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন হয়েছে এবার।
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী স্মৃতি আক্তার জানায়, এ ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমি ২০০ টাকা দিয়েছে। আমরা প্রতিবছরই ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন অব্যাহত রাখতে চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা সোনা মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন যাবত শিশুরা এভাবেই অস্থায়ী শহীদ বেদি তৈরি করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে। তাদের ভাষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান দেখে আমি বিমোহিত। আগে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা জানাতে তাদের দুই কিলোমিটার দূরে যেতে হতো। এখানে অস্থায়ী শহীদ বেদি তৈরি হওয়ায় এখন আর দূরে যেতে হয় না। প্রতিবছরই তাদের এ কাজে অমি উৎসাহ দিয়ে আসছি। শিশুদের এ দিবস উদযাপনের জন্যই আমি এই জমিটি প্রতিবছরই অনাবাদী রাখি।
শ্রীপুর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সাঈদ চৌধুরী বলেন, এই শিশুরাই হবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শহীদ দিবস সম্পর্কে এখন থেকেই তাদের জানাতে হবে। ছোট্ট কোমলমতি শিশুদের নিজ উদ্যোগে কলাগাছ, রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি শহীদ মিনার সমাজে এক অসামান্য সৌন্দর্য বহন করে। জাতির জন্য এটা খুব দরকার। অভিভাবকরাও তাদের শিশুদের নিয়ে এগিয়ে আসবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তিনি আরও বলেন, সরকার বিদ্যালয়গুলোতে যে শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেসব জায়গায় শহীদ মিনার থাকবে তার পাশেই এর ইতিহাস ওই মিনারের সঙ্গেই লিপিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।
শিহাব খান/এসজে/জিকেএস