বহুদিন পর দেখা মিলল সাপের খেলা
‘আমার কি মা বইন নাই? চুরি কইরা খাওন ভালো নাকি চাইয়া খাওয়া ভালো? দরকার হইলে চাইয়া খামু।’ সাপ বেজির খেলা দেখাতে দেখাতে কথাগুলো বলছিলেন সাপুড়িয়া ফয়াসাল (২৫)।
সাপের খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ হয় তার। একেক দিন একেক জায়গায় গিয়ে সাপের খেলা দেখিয়ে মানুষকে বিনোদন দিয়ে ও তাবিজ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন তিনি।
১০ থেকে ১৫ বছর আগেও চাঁদপুরে বিভিন্ন হাট বাজারে মাঝে মাঝে দেখা যেত সাপের খেলার দৃশ্য। ইদানিং সেটা কম দেখা গেলেও একেবারে যে নেই তা নয়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় কিছু সাপুড়ে গ্রামে গ্রামে হেঁটে সাপ ধরার পাশাপাশি নানান কথার ফুলঝুরির মাধ্যমে তাবিজ কবজের ব্যবসা করছেন।
যদিও তাদের এই তাবিজের ব্যবসাটিকে একেক জন একেকভাবে দেখে। কেউ বলে প্রতারণা আবার কেউ এটাকে নেন একটু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে।
রোববার দুপুরে দেখা হলো তেমনই এক সাপুড়েকে হরিনা ফেরিঘাট বাজারে সাপের খেলা দেখানোর কসরত সাজিয়ে বসতে। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরের ওপর এ ধরনের সাপের খেলা দেখা হইনি। তাই আগ্রহ নিয়েই দেখা শুরু।
খেলা দেখাতে এ সময় তাদের তিনজনের একটি সংঘবদ্ধ টিম দেখা যায়। দুজন সাপের খেলা দেখাচ্ছে। আরেকজন পাশে দাঁড়িয়ে।
জানা যায়, সাপুড়ে একজনের নাম আমজাদ (৩৫) আর তার ওস্তাদ ফয়সাল (২৫) এবং আরেকজনের নাম আওলাদ (৬২)। তিনি ওস্তাদ ফয়সালের বাবা। এছাড়াও সারা দেশে মোট সাড়ে ১২ লাখ সাপুড়ে আছে বলেও জানান তারা। সবাই নাকি এভাবেই সাপের খেলা দেখিয়ে সংসার চালায়।
জানা যায়, তারা সবাই মুন্সিগঞ্জের মুন্সিরহাট এলাকার বাসিন্দা। গত ৮-১০ দিন আগে চাঁদপুরে এসেছেন পুরো পরিবার একসাথে। আপাতত শহরের ৫নং ঘাট বেদে পল্লীতে থাকছেন। তারা সারাবছর এভাবেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সাপ ধরে এবং সাপের খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এবার ২০-২৫ জনের একটি টিম নিয়ে তারা চাঁদপুর এসেছেন। কয়েকদিন পরে আবার অন্য কোনো জেলায় চলে যাবেন।
খেলার দেখানোর শুরুতে একটি বেজি ও একটি সাপ খোলা জায়গায় ছেড়ে রাখেন তারা। এ সময় বীন বাজাতে থাকেন। ফলে ধীরে ধীরে সেখানে মানুষ একত্রিত হয়। তারপর সাপ বেজির লড়াই দেখানোর কথা বলে শুরু করেন কথার ফুলঝুরি। এক কথা থেকে শুরু করে অন্য কথা। আর এর মাঝেই একটা একটা করে ৩টা সাপ দেখান তারা।
এ সময় গাছের এক টুকরো ছাল দেখিয়ে সাপের সামনে ধরেন যা দেখে সাপ খুব ভয় পায় এবং তাদের বক্সে লুকিয়ে পড়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন তারা। এসব দেখেই গাছের টুকরো দিয়ে তৈরি তাবিজ কিনতে সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং সবাই তাদের কথা শুনে বিশ্বাস করে একটি করে তাবিজ কেনেন।
এই একটা তাবিজ তারা বিক্রি করেন ১০০ টাকা করে। এ সময় মোট ৬টি তাবিজ বিক্রি করতে দেখা যায়। যার মূল্য ৬০০ টাকা। এভাবেই তারা প্রতিদিন কয়েকটি জায়গায় খেলা দেখায়। আর এভাবেই চলে তাদের রুজি।
খেলা শেষে একান্ত আলাপকালে তারা জানান, দাদা আমরাতো চুরি করি না। কাজ করে খাই। আমাগো ঘরেওতো মা-বইন আছে, আমরা যদি কিছু না করি তাইলে তারা খাইবো কি। আর আমরাতো গাছের ছাল দিয়ে মেডিসিনের কথা বলি। অন্য কিছু না। এই সাপগুলোকেও তো খাওয়াইতে হয়। বেজিটারে খাবার দিতে হয়। তাদের পিছনেও আমাদের খরচ আছে।
তারা আরও বলে, অনেকে মনে করে আমরা অনেক টাকা কামাই করি। কিন্তু ভাই আসলে তা না। দিনে দুই তিন জায়গায় খেলা দেখাইতে পারি। ১৫শ থেকে ২০০০ টাকার মতো আয় হয়। আমরা তিনটা লোক সারাদিন খেলা দেখাই। খাওয়া দাওয়া খরচ, সাপের খাওন খরচ, আবার আমাগো পরিবার আছে। কোনো রকমে চলি।
সাপুড়েদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনটি সাপের মধ্যে একটি সাপের নাম দাড়াইস সাপ, আরেকটি দুধরাজ ও অপরটি সানক সাপ। খেলার শেষ সময়ে তারা আরেকটা সাপ দেখান যার নাম সুতানালি সাপ।
তারা আরও জানান, এগুলোর খাবার হিসেবে তারা দুধ, কলা, পানি, মাছ ও মুরগির বাচ্চা খেতে দেন। একটি সাপ সর্বোচ্চ তাদের কাছে এক মাস জীবিত থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সাপটা মারা যায়। এর মধ্যেই তাদের অন্য সাপ সংগ্রহ করতে হয়।
তারা জানান, ‘সাদা লজ্জাবতী গাছ সাপের বিশের মেডিসিন হিসেবে নাকি কাজ করে। তাই তারা এই গাছের ছাল বিক্রি করেন।’
সাপুড়েদের দেয়া তথ্য মতে, সাপগুলো কিনে নেয় চীন ও কোরিয়ার মানুষেরা। তারা এই সাপের বিষ থেকে ওষুধ তৈরি করে।
নজরুল ইসলাম আতিক/এফএ/জেআইএম