নির্ভরতার কৃষিতে ছুটছে অর্থনীতির চাকা
কৃষিতে আশাতীত সাফল্যের দেশ বাংলাদেশ। দেশে লোকসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষিজমি বরং প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমেছে। এর পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টির নিরাপত্তাও। তাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের কৃষিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করছে বিশ্ব।
খাদ্যশস্য, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ । চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। স্বাধীনতার পর দেশে যে চাল উৎপাদন হতো এখন তার চেয়ে তিনগুণ বেশি উৎপাদন হয়। ওই সময় যেখানে প্রতি হেক্টরে চালের উৎপাদন ছিল দেড় টন, তা এখন চার টনেরও বেশি।
একইভাবে গমে উৎপাদন দ্বিগুণ আর ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। ২০২০ সালে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পরিমাণে অর্ধেক ছিল। ভুট্টায় সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে শেষ দশকে। ২০০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন ছিল সাড়ে সাত লাখ টন, যা ২০২০ সালে ৫৪ লাখ টন। আগামী ৫ বছরের মধ্যে শস্যটির উৎপাদন এক লাখ টনে উন্নীত করতে কাজ চলছে।
প্রধান খাদ্যশস্যের বাইরে নিবিড় চাষের মাধ্যমে দেশে সবজি উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। শস্যের জমি কমলেও গত এক দশকে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ আবাদি জমি বৃদ্ধির হার বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)।
এমন অবস্থায় গত বছর সবজি উৎপাদন বেড়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। গত বছর আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন। এছাড়া এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজির মধ্যে বেশির ভাগের বাণিজ্যিক উৎপাদিন হচ্ছে। কয়েক দশক আগেও হাতেগোনা কিছু সবজির বাণিজ্যিক উৎপাদন হতো। পাশাপাশি সবজি রফতানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা। গত এক বছরে শুধু সবজি রফতানি থেকেই আয় বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
বড় সফলতা এসছে ফল উৎপাদনে । দেশ মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম। কিন্তু মৌসুমি ফল উৎপাদনে গত বছর বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। এফএওর হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে।
কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
বড় সাফল্য রয়েছে পানীয় উৎপাদনে। এক সময় উৎপাদন থেকে চায়ের চাহিদা বাড়ায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছিল পণ্যটি। সে পরিস্থিতি কেটে এখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে ১৬৬ বছরের চা চাষের ইতিহাসে উৎপাদনেও রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ওই বছর উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি, যা তার আগের বছরের চেয়ে এক কোটি ৩৯ লাখ কেজি বেশি। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম।
যে কারণে বড় সাফল্য
কৃষিতে অভাবনীয় এ সাফল্যের পেছনে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার ও যন্ত্রের ব্যবহার প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া বিশেষ অবদান রাখছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে।
এর মধ্যে ধানের জোগানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এ সংস্থার বিজ্ঞানীদের হাত ধরে কৃষকরা ১০০টি নতুন জাতের ধান পেয়েছেন। ধানের সিংহভাগের জোগান আসছে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে।
ছয়টি হাইব্রিডসহ ৯৪টি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন কৃষিতে অন্যতম সাফল্য এনেছে। ব্রির এসব জাতের মধ্যে ১০টি লবণাক্ততা সহনশীল, রোপা আমনের খরা সহনশীল তিনটি, জলাবদ্ধতা সহনশীল চারটি, পুষ্টিসমৃদ্ধ পাঁচটি এবং রফতানিযোগ্য বিশেষ চারটি জাতের ধান রয়েছে।
এদিকে অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবনে বড় অবদান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি)। এ প্রতিষ্ঠান দানাশস্য, কন্দাল, ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফল, মসলা, ফুল প্রভৃতির উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে আসছে। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বারি বিভিন্ন ফসলের ৫৮৭টি উচ্চ ফলনশীল জাত ও ৫৫১টি ফসল উৎপাদন প্রযুক্তিসহ ৯০০টিরও বেশি কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত স্বল্পকালীন উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল ধান, গম, সরিষা, মুগ, বাদাম, ছোলা, মসুর, পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদসহ ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত কৃষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সার-বীজ এখন সমস্যা নয়
এক সময় যে সার ও বীজ নিয়ে ছিল হাহাকার, সেটা এখন বেশ সহজলভ্য। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফসল আবাদের জন্য কৃষক এখন বেশি পরিমাণ গুণগতমান সম্পন্ন বীজ ও সার পাচ্ছেন।
এক সময়ের ৮০ টাকার টিএসপি সার ২২ টাকা, ৭০ টাকার এমওপি ১৫ ও ৯০ টাকার ডিএপি ১৬ টাকায় দেয়া হচ্ছে। সারের মূল্য হ্রাসের ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ উল্লেখ্যযোগ্যভাবে কমেছে।
অপরদিকে বেড়েছে সারের সরবরাহও। যেখানে আগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) থেকে বিভিন্ন ফসলের বীজ সরবরাহ করা হতো দুই লাখ ৬১ হাজার ৫৯ টন, তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৬২৩ টনে।
পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সহায়তায় উন্নত জাতের বীজ প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও বেড়েছে। দেশে এ পর্যন্ত ১৭ হাজার ২৭৫টি বীজ উৎপাদন ব্লক তৈরি হয়েছে। ফলে সহজে ও কম মূল্যে বীজ কিনতে পারছেন কৃষকরা।
কৃষির প্রাণ কৃষক-ই
সবকিছুর পরও যে কৃষির প্রাণ কৃষকরাই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৯৭০ সালে কৃষিজমিতে বছরে একটি ফসল হতো, তারাই এ জমিকে দুই ফসলি করেছেন। কোথাও কোথাও একটি জমিতে বছরে চারটি ফসল ফলিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন বাংলার কৃষক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগও সোনার ফসল ফলিয়েছেন কৃষক। এমনকি দাম না পাওয়াসহ অন্যান্য বিপর্যয়ও দমাতে পারেনি কৃষকদের।
এদিকে দেশের শ্রম জরিপ প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা ৬৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
তথ্য বলছে, কৃষিতে দেশের ৪১ শতাংশ শ্রমজীবী। গত চার যুগে দেশের কৃষি পরিবার পুরুষপ্রধান থেকে নারীপ্রধান হয়ে উঠেছে। নারীপ্রধান পরিবার ৬৭ শতাংশ।
সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সরকার প্রথম থেকেই খাদ্য নিরাপত্তা ও ঘাটতি কমাতে আন্তরিক ছিল। যেভাবে সরকার কৃষিখাতে অর্থিক সমর্থন ও নীতিগত সহায়তা দিয়েছে তা অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। কৃষিখাতে এ অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না।
তিনি আরও জানান, গত অর্ধশতাব্দিতে দেশে শস্যের উৎপাদন গড়ে ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। যেখানে সারাবিশ্বে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে দেশের বড় সাফল্য এখন কৃষি। আমাদের চাল উদ্বৃত্ত, বেশকিছু খাদ্যে প্রথম সারির উৎপাদক। শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। অন্যদিকে সরকারি গুরুত্বের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও প্রচুর বেড়েছে। সবমিলে উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে, প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও।
এনএইচ/এএইচ/এমকেএইচ