ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

৪ পুরুষ ধরে নেই আঙুলের ছাপ!

ফেরদৌস সিদ্দিকী | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৪:০৯ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

সাত বছর বয়সে স্বামীর বাড়িতে এসেছিলেন সুমিতা সরকার। নেহাতই শিশু ছিলেন তখন। ওই বয়সে স্বামী-সংসার কিছুই বুঝতেন না তিনি। কিন্তু স্বামী জগবন্ধু সরকারের হাত-পায়ে সমস্যা টের পেতেন ঠিকই।

সুমিতা সরকার জানিয়েছেন, তার স্বামী শৈশবে বাবা হারিয়েছেন। তিনি ছিলেন শ্বশুরের একমাত্র সন্তান। স্বামীর কাছে শুনেছেন, এ সমস্যা তার শ্বশুরেরও ছিল। তিনিও ছিলেন বাবার একমাত্র সন্তান। তার ধারণা, শ্বশুরের বাবারও এ সমস্যা থাকতে পারে।

জগবন্ধু-সুমিতা দম্পতির চার ছেলের প্রত্যেকেই জন্ম নেন বিরল এ বংশগত সমস্যা নিয়ে। মেজ ছেলে অমল সরকারের (৪৭) দুই সন্তান-অপু সরকার (২২) এবং অনু সরকার (১৫) বিরল এ বংশগত সমস্যায় ভুগছেন।

অপু সরকার মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট এবং তার ভাই অনু সরকার পচামাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আঙুলের ছাপ না থাকায় পদে পদে ভুগতে হচ্ছে তাদের।

জগবন্ধু-সুমিতা দম্পতির বড় ছেলে নিরাঞ্জন সরকারও (৫৮) দুই ছেলের জনক। তার ছোট ছেলে আদিত্য সরকার (২০) পরম্পরায় জন্মেছেন এ সমস্যা নিয়ে। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদিত্য। তিনিও পড়ছেন ভোগান্তিতে।

jagonews24

নিরাঞ্জন সরকারের ছোট ভাই গোপেশ সরকার (৪৫) এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তাদের মধ্যে কারো এ সমস্যা নেই। তবে বংশ পরম্পরায় তাদের এ সমস্যা ফিরবে কি-না তা নিয়ে রয়েছেন উৎকণ্ঠায়।

২০০৮ সালের আগে এ সমস্যা সমস্যাই মনে হয়নি পেশায় কৃষক অমল সরকারের। কিন্তু ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে প্রথমবারের মতো তিনি বিড়ম্বনায় পড়েন।

বার বার চেষ্টা করেও আঙুলের ছাপ নিতে পারেননি ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। শেষে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে 'আঙুলের ছাপ নেই' লিখে দেন সংশ্লিষ্টরা।

এরপর প্রায় এক দশক কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু ২০১৬ সালে মোবাইল সিম কার্ডের জন্য বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হওয়ার পর অমল সরকার ফের বিড়ম্বনায় পড়েন।

স্ত্রীর নামে নেয়া সিম এখন ব্যবহার করছেন অমল সরকার। তার দুই ছেলে অপু ও অনুর ব্যবহৃত সিমগুলো একই নামে নেয়া।

jagonews24

২০১০ সাল থেকেই পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক। একই নিয়ম ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও। সার্জন দফতরের মেডিকেল বোর্ড থেকে পাওয়া স্বাস্থ্য সনদ দেখিয়ে বছর ঘুরে পাসপোর্ট পেলেও ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলেনি অমল সরকারের।

আরেক ভাই গোপেশ সরকার প্রায় দুই বছর অপেক্ষার পর সম্প্রতি পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আঙুলের ছাপ না থাকায় গোপেশ সরকার হাসপাতালে ডিজিটাল হাজিরার পরিবর্তে পুরোনো পদ্ধতিতে খাতায় স্বাক্ষর করেন। বড় ভাই নিরাঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা।

পৌঢ়া সুমিতা সরকার স্বামী হারিয়েছেন বহু আগে। মেজ ছেলে অমল সরকারের পরিবারে বাস করছেন তিনি। অমল সরকার রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের পচামাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা।

তার বড় ভাই নিরাঞ্জন সরকার সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে যশোর জোনাল ভূমি অফিসে কর্মরত। স্থায়ী নিবাস পুঠিয়ায় হলেও চাকরি সূত্রে নিরাঞ্জন সরকার বাড়ির বাইরে অবস্থান করেন।

ছোট ভাই গোপেশ সরকার দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের রেডিও টেকনোলজিস্ট। পরিবার নিয়ে তিনি সেখানকার নিমনগর বালুবাড়ি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় অমল সরকারের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রথম সমস্যা ধরা পড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে। এরপর সমস্যা হয়েছে মোবাইলের সিম তুলতে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ি পাসপোর্ট নিতে গিয়ে। নির্ধারিত আবেদন ফরম জমা দেয়ার পর মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা পেয়ে ছবি এবং আঙুলের ছাপ দিতে পাসপোর্ট দফতরে যাই। বহু চেষ্টার পরও সেখানকার কর্মীরা তার আঙুলের ছাপ নিতে পারেনি। শেষে সিভিল সার্জনের দফতরের মেডিকেল সনদ জমা দেয়ার এক বছর পর হাতে পেয়েছি পাসপোর্ট।

jagonews24

কিন্তু আঙুলের ছাপ বিড়ম্বনায় এখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাননি বলে জানান অমল সরকার।

তিনি বলেন, নানা তদবির করে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করেছি। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স না পেয়ে বিআরটিএতে ফি জমার রসিদ দেখিয়ে চলতে হয়। অনেক সময় দায়িত্বরত সার্জেন্ট বিষয়টি আমলে নেন। আবার কখনো কখনো মামলা দেন। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পদে পদে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।

অমল সরকার আরও জানান, বিরল এ সমস্যা তার বাবার ছিল। বাবার মুখে শুনেছেন একই সমস্যা ছিল দাদা এমনকি তার বাবারও। কৃষিকাজ করতেন বিধায় তারা কখনো এটি সমস্যাই মনে করেননি। কিন্তু এখন সরকারি নানা সেবার ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক হওয়ায় তিনি ও তার পরিবার চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। বিষয়টি চরম অস্বস্তির বলে জানান অমল সরকার।

অমল সরকারের ছেলে অপু সরকার বলেন, জন্মের পর থেকে এমন হাত দেখে আসছি। ফলে এটি সমস্যাই মনে হয়নি। কিন্তু অন্য মানুষের থেকে আলাদা তা বুঝতেন।

মূলত বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন থেকে সমস্যা শুরু হয়। এরপর বাবা মোটরসাইকেল কিনলেন। গাড়ির কাগজপত্র পেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর পাসপোর্ট হাতে পেলেও এখনো মেলেনি ড্রাইভিং লাইসেন্স।

jagonews24

অপু জানান, এখন তারা যে সিম ব্যবহার করেন সবগুলোই মায়ের নামে তোলা। সিম সংক্রান্ত সমস্যা হলেই বড় ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তবে স্বাস্থ্য সনদ দেখিয়ে সম্প্রতি তিনি ও তার বাবা জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্টকার্ড করেছেন।

অপু সরকার জানিয়েছেন, বিষয়টি গণমাধ্যমে আসায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের বাড়িতে এসে নমুনা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। প্রয়োজনে তাদের ঢাকায় নেয়ার কথাও জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল জানান, ওই পরিবারের ছয় সদস্য বিরল এই রোগে আক্রান্ত। তাদের তিন ভাইয়ের দুজন সরকারি চাকরি করেন।

তিনি যতদূর জেনেছি, এটি প্রকৃতিগত সমস্যা। এ নিয়ে তেমন কিছুই করার নেই। আঙুলের ছাপ ছাড়া কোনো সেবা প্রয়োজন হলে সেটি ইউনিয়ন পরিষদ নিশ্চিত করবে।

আঙুলের ছাপ না থাকা ‘অ্যাডারমাটোগ্লিফিয়া’ বা ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’ হিসেবে ধরে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পরিবারটি এ সমস্যায় ভুগছে কিনা তা নিশ্চিত নয় স্থানীয় স্বাস্থ্য দফতর। শিগগিরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিতের চেষ্টাও চলছে।

jagonews24

এর আগে এই বছরের ১৫ মার্চ অমল সরকারকে মেডিকেল সনদ দেয়া স্বাস্থ্য সনদে এই সমস্যাকে 'কনজেনিয়াল পালমোপ্লান্টার কেরাটোডার্মা' হিসেবে চিহ্নিত করেন সিভিল সার্জন দফতরের তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। এ কারণেই তার আঙুলের ছাপ দেয়া সম্ভব নয় বলেও জানায় বোর্ড।

কেবল স্বাস্থ্য সনদ দিয়েই দায় সেরেছেন তৎকালীন জেলার সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক। পদোন্নতি পেয়ে বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপপরিচালক হিসেবে তিনি যোগদান করেন।

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ডা. এনামুল হক বলেন, আসলে বিষয়টি দায়িত্ব এড়ানো নয়, সমস্যাটি বিরল। দেশে এ নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। কাজেই সে যাত্রাই থেমে যেতে হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, স্বাস্থ্য দফতর উপর লেভেলে বিষয়টি নিয়ে চিঠি চালাচালি চলছে। এ নিয়ে আরও বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সুইটজারল্যান্ডের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার ইটিন এবং আরও কয়েকজন গবেষক এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ২০১১ সালে। ওই গবেষণায় তারা এই বংশগত বা জেনেটিক সমস্যার জন্য দায়ী জেনেটিক মিউটেশনটি শনাক্ত করেন। গবেষণার সময় পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট চারটি পরিবার শনাক্ত হয়েছিল, যারা বংশগতভাবে এই সমস্যায় ভুগছেন। এর সবগুলোই ছিল এশিয়ার বাইরে।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএইচ/জেআইএম