ঠাকুরগাঁওয়ে আলু নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড
দেশে আলু চাষে দ্বিতীয় স্থানে ঠাকুরগাঁওয়ের অবস্থান। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিভিন্ন জেলাসহ বিদেশে রফতানি হয় ঠাকুরগাঁওয়ের উৎপাদিত আলু। আলু চাষের জন্য বীজ আলু বেশির ভাগ জোগান দেয় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। কিন্তু এবার জেলার আলু চাষিদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগ দিনাজপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালকের বিরুদ্ধে।
আলু বীজ ডিলারদের জন্য ৪২-৪৩ টাকা প্রতি কেজি নির্ধারণ করা হলেও চাষিদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬-৪৭ টাকা। ডিলাররা আবার ৪২-৪৩ টাকার আলু ৫৩-৫৫ টাকা দরে বিক্রি শুরু করেছেন। একজন বীজ ডিলারের জন্য ৫-১৫ মেট্রিক টন বীজ আলু বরাদ্দ দেয়া হলেও একজন তালিকাভুক্ত চাষির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২৪০ কেজি। ২৪০ কেজি আলু পাওয়ার জন্য মানতে হচ্ছে অনেক নিয়মকানুন। বাবার বরাদ্দের আলু দেয়া হয়নি ছেলেকে, আবার ৫-৮ জন ডিলারের বরাদ্দের আলু একজনের মাধ্যমে উত্তোলনের অভিযোগও রয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের মাধ্যমে চাষিদের কাছে বীজ আলুর জন্য ৩ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন আহ্বান করে বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগ দিনাজপুর অঞ্চল (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়)। নিদিষ্ট তারিখের মধ্যে তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক চাষি বীজ আলুর জন্য আবেদন করেন। গত ৮ নভেম্বর বিকেলে বীজপ্রাপ্ত চাষিদের তালিকা প্রকাশ করেন বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগ দিনাজপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মজহারুল ইসলাম।
ওইদিন তিনি প্রতি আবেদনর জন্য দুই জাতের মিলে ২৪০ কেজি আলু বরাদ্দ দেন। প্রতি কেজি আলু এস্টারিক্স ও গ্র্যানোলা ডিলার পর্যায়ে বড় আলু ৪২ ও ছোট আলু ৪৩ টাকা এবং চাষি পযার্য়ে বড় আলু ৪৬ ও ছোট আলু ৪৭ টাকা নির্ধারণ করে বিপণন বিভাগ। আর ৮ নভেম্বর রাতে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগে ই-মেইল দিয়ে চাষিদের ৯ নভেম্বরের মধ্যে পে-অর্ডারের মাধ্যমে দিনাজপুর অফিসে টাকা জমা দেয়ার কথা বলা হয়। চাষিদের জন্য মাত্র একদিন সময় দেয়া হলেও বীজ ডিলারদের জন্য সময় দেয়া হয় পাঁচ দিন। কৃষি বিভাগের খবর পাওয়ার পরে বেশিরভাগ তালিকাভুক্ত চাষি টাকা পে-অর্ডার করতে পারেননি। বীজ আলু না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন আলু চাষিরা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রহিমানপুরের আলুচাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগ দিনাজপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মজহারুল ইসলামের সাধারণ চাষিদের নামে বরাদ্দ দিয়ে একদিন মাত্র সময় দিয়েছেন যেন আমরা আলুর জন্য টাকা জমা দিতে না পারি। আমাদের বরাদ্দ আলু তিনি বেশি দামে অন্যজনের কাছে বিক্রি করবেন।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের আলুচাষি আব্দুল গণি বলেন, ‘কৃষি বিভাগের মাধ্যমে বিএডিসিতে বীজ আলুর জন্য আবেদন করেছিলাম। চাহিদা দিয়েছিলাম দুই হাজার কেজির। আলু বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ২৪০ কেজি। বাড়ি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অফিস তাই ছেলেকে আলু নিতে পাঠিয়েছিলাম। বিএডিসির বিপণনের উপ-পরিচালক ছেলেকে আলু দেয়নি। তিনি বলেছেন, একজনের আলু অন্যজনকে দেয়া যাবে না। অথচ একজন ডিলারকে দশজন ডিলারের আলু দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে আলু নেব। তাহলে বাবার আলু কেন ছেলেকে দেয়া যাবে না? ডিলারদের কাছে আলু কিনতে গেলে তারা বলে আলু নেই। তাহলে কি আমরা আলু চাষ করতে পারব না?’
বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগ দিনাজপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মজহারুল ইসলামের কাছে চাষিদের জন্য একদিন ও ডিলারদের জন্য পাঁচদিন সময়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজের অনেক চাপ। তাই বীজ বিক্রয় কমিটির সিদ্ধান্তমতে চাষিদের ও বীজ ডিলারদের সময় দেয়া হয়েছিল। যারা টাকা জমা দিতে পারেনি তাদের জন্য করার কিছুই নেই।’
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আফতাব হোসেন বলেন, ‘যারা প্ররিশ্রম করে আলু উৎপাদন করে তাদের জন্য মাত্র একদিন সময় দেয়া হয়েছে, যা ঠিক হয়নি। অনেক চাষি আলু বীজের টাকা পে-অর্ডার করতে পারেননি। বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগে কথা বলব, যাতে কৃষকদের জন্য সময় বৃদ্ধি করা হয়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি বিপণন বিভাগ আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারিভাবে খুচরা আলুর দর নির্ধারণ করেছে ৩০ টাকা। সে হিসেবে আলুচাষিরা আশাবাদী ছিলেন বিএডিসির আলু ৩৫ টাকার মধ্যে পাবেন তারা। কিন্তু বিএডিসি চাষিদের জন্য ৪৬-৪৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। এখন তাদের প্রতি কেজি বীজ আলু কিনতে হচ্ছে ৫৩-৫৫ টাকায়। বিএডিসি চুক্তিবদ্ধ চাষিদের থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে ১৮৫ টন আলু সংগ্রহ করে ২২ও ২৩ টাকা দরে। সেই আলু এখন সরকারিভাবে বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৭ টাকা। অথচ চাষিকে নিতে হচ্ছে ৫৩-৫৫ টাকা দরে।
তানভীর হাসান তানু/এসআর/জেআইএম