এক মাসেও রায়হানের শার্ট-মোবাইল ফোন ফিরে পাইনি : মা
সিলেট নগরের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলার সব আলামত দ্রুত সংগ্রহের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আহ্বান জানিয়েছেন নিহত রায়হানের মা সালমা বেগম। শনিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে নগরের আখালিয়ার নেহারিপাড়ার নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ আহ্বান জানান।
সালমা বেগম বলেন, আমার নিরপরাধ ছেলেকে কারা ধরে ফাঁড়িতে নিয়ে যায়, তাকে কী জন্য কারা নির্যাতন করে হত্যা করেছে সে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার হয়নি। এ মামলায় আশেক এলাহিসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা কেনইবা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছেন না- এটা আমার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। তবুও আমি আশাবাদী তদন্ত সংস্থা পিবিআই রায়হান হত্যার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করে এসআই আকবরসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য হত্যা করেন বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের। তাকে ছিনতাইকারী অপবাদ দিয়ে পুলিশ জানায়, রায়হান গণপিটুনিতে মারা গেছেন।
এ ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত পুলিশের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গত ৯ নভেম্বর সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার পরপরই তিনি পালিয়ে ভারতে চলে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর ১০ নভেম্বর তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পর শনিবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বৃহত্তর আখালিয়া (বারো হামছায়া) সংগ্রাম পরিষদ, সিলেট ও পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের পরিবার।
নিজ বাড়িতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, আটক হওয়ার পর এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বুদ্ধিতে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরাও মনে করি রায়হান হত্যা এবং আকবরের পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত। রিমান্ডে আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে হবে। এছাড়া রায়হান হত্যার সঙ্গে আর কারা জড়িত তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের।
নিহত রায়হানের মা বরখাস্ত হওয়া এসআই আকবরকে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন এবং কানাইঘাট সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
রায়হান হত্যার আলামত সঠিকভাবে সংগ্রহ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ১০ অক্টোবর রাতে রায়হানকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তখন তার পরনে ছিল নীল রঙের একটি শার্ট। অথচ পরদিন ১১ অক্টোবর সকালে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা রায়হানের মরদেহের পরনে ছিল লাল স্টাইপের একটি ছোট শার্ট, যা তার শরীরে লাগেনি। এছাড়া মরদেহ হস্তান্তরের সময় তার মোবাইল ফোনও ফিরিয়ে দেয়নি পুলিশ। রায়হান মারা যাওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এর কোনোটিই ফিরে পাইনি আমরা। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারী সংস্থাকে এই আলামতগুলো উদ্ধার করতে হবে। নতুবা এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব হবে না।
রায়হান হত্যা মামলায় আকবর ছাড়াও তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পিবিআই। ঘটনার দিন বন্দরবাজার ফাঁড়িতে কর্মরত থাকা এএসআই আশেক এলাহি, কনস্টেবল টিটু চন্দু দাস ও হারুনুর রশীদ রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।
তারা জবানবন্দি না দিলেও এই মামলার সুষ্ঠু বিচারের ক্ষেত্রে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা জজ কোর্টের সাবেক পিপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
সংবাদ সম্মেলনে সংহতি জানিয়ে দেয়া বক্তব্যে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, পুলিশের তদন্ত কমিটি নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ আছে। প্রত্যক্ষদর্শী তিন পুলিশ সদস্য ১৬৪ ধারায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন আসামিরা জবানবন্দি না দিলেও বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এছাড়া এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত এসআই আকবর। ঘটনার সময় বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন। তার নেতৃত্বেই নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে সবাই বলছেন। আটকের পর জনতার কাছে আকবরও স্বীকার করেছেন পাঁচ-ছয়জন মিলে মারধর করেছেন। ফলে তার জবানবন্দিই এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, জেলা আইনজীবী সমিতি রায়হানের পরিবারকে আইনি সহায়তা দেবে। সে লক্ষ্যে সমিতির পক্ষ থেকে আইনজীবীদের প্যানেল করা হচ্ছে। এই প্যানেলের মাধ্যমে আমরা রায়হান হত্যা মামলা বিনা পয়সায় পরিচালনা করব। এছাড়া জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের পক্ষে আইনজীবী সমিতির সদস্যরা না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
রায়হান হত্যার বিচারের দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী মিলে গড়ে তুলেছেন ‘বৃহত্তর আখালিয়া (১২ হামছায়া) সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এ পরিষদের আহ্বায়ক ও সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলেছুর রহমান কামরান সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠকালে বলেন, রায়হান হত্যার তদন্তে কোনো অবহেলা হলে বা কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে নামব।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে বৃহত্তর আখালিয়া (১২ হামছায়া) সংগ্রাম পরিষদের নেতা সিলেট সিটি করপোরেশনের ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান, সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাস, সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েছ লোদী, মহানগর আওয়ামী লীগের ৮ নং ওয়ার্ড শাখার সভাপতি মো. সিদ্দিক আলী, রায়হানের স্বজন শওকত আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ছামির মাহমুদ/আরএআর/এমকেএইচ