সরকারি কোটি টাকার আগর বাগানে লেবু চাষ!
চায়ের দেশ মৌলভীবাজারের অন্যতম শিল্প আগর-আতর। জেলার বড়লেখার সুজানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও ৫০ থেকে ৬০টি আগর-আতর কারখানা। তবে ৩শর মতো কারখানা থাকলেও বন বিভাগ বলছে ১৭৬টি কারখানা এখন পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে। এখান থেকে শত শত কোটি টাকার আগর আতর বিক্রি হয় বিভিন্ন দেশে।
৩শ বছর আগেও আগর-আতরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের বইয়ের সূত্র ধরে। তবে বাণিজ্যিকভাবে আগর আতর উৎপাদন বা এর বিস্তার ঘটে ১৯৪০ সালের দিকে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কয়েকটি আগর বাগান ঘুরে দেখা গেছে, আগর বাগানের মাঝে লাগানো হয়েছে অন্য গাছ। অনেক স্থানে আগর গাছের অস্তিত্বই নেই। আবার অনেক বাগানে আগর ধ্বংস করে করা হয়েছে লেবু চাষ। বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষ বিভাগের আওতায় সৃজিত আগর বাগানই বেশি ধ্বংস হয়েছে।
মধ্যে অনেকবার মুখ থুবড়ে পড়ে এই শিল্প। বিশেষ করে ৯০’র দশকে কাঁচামালের সংকটে এই শিল্প বন্ধের উপক্রম হয়।
সম্ভাবনাময় এই রফতানি খাতকে রক্ষা করতে বন বিভাগ এগিয়ে আসে। নতুন আগর বন সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৯৮ এবং ২০০৬ সালে সরকার দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এর আওতায় সিলেট ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে আগর বাগান সৃজন করা হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে মাত্র ৫০ ভাগ বাগান টিকে আছে। আর এজন্য বনবিভাগ ও সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীরা একে অন্যকে দায়ী করছেন।
বন বিভাগসূত্র জানায়, ১৯৯৮ সালে ‘পাইলট প্রজেক্ট ফর আগর প্লান্টেশন’ নামে পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সারাদেশে পাঁচ হাজার হেক্টর নতুন বন সৃজন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। সিলেট চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলার বনভূমিতে ১৯৯৮-২০০৪ অর্থ বছরে ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭৮৫ দশমিক ৬৭ হেক্টর জমিতে আগর বাগান সৃজন করা হয়।
এরমধ্যে সিলেটে ১০ হেক্টর, হবিগঞ্জে ১০২ হেক্টর, মৌলভীবাজারে ২১২ দশমিক ১৬ হেক্টর, চট্টগ্রামে ২৮১ দশমিক ৯২ হেক্টর, কক্সবাজারে ১৮৮ দশমিক ৯২ হেক্টর আর রাঙামাটিতে ৫ হেক্টর। জুন ২০০৬ সালে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। তবে মেয়াদ শেষে কী পরিমাণ জমিতে গাছ লাগানো হয়েছিল এবং কত টাকা ব্যয় হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনি বনবিভাগ।
এই প্রকল্পের আগে মৌলভীবাজারে ২১২ দশমিক ১৬ হেক্টর দেখানো হলেও বর্তমানে বাগানের পরিমাণ ১৫৫ দশমিক ১৬ হেক্টর। যা আগের চেয়ে প্রায় ৫৭ হেক্টর কম। এরমধ্যে মৌলভীবাজারের জুড়ি রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৩ অর্থবছরে ২৭ হেক্টর, বড়লেখা রেঞ্জে ২০০১-২০০৫ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৩৩ হেক্টর, কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৩ বছরে ৩৫ হেক্টর, কুলাউড়া রেঞ্জে ২০০৩-২০০৪ বছরে ৫ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল রেঞ্জে ১৯৯৯-২০০৫ সাল বছরে ৬৩ দশমিক ৮৩ হেক্টর অর্থাৎ ১৯৯৯- ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট ১৫৫ দশমিক ১৬ হেক্টর দেখানো হয়েছে যা পূর্বের তথ্যের সঙ্গে মারাত্মক গড়মিল।
এরপর ২০০৬ সালের জুলাই মাসে নেয়া হয় দ্বিতীয় প্রকল্প। পাঁচ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প শেষ হয় ২০১১ সালে। এই প্রকল্পের আওতায় সিলেট বন বিভাগের অধীনে মৌলভীবাজারে মোট ৬৬৫ হেক্টর জমিতে আগর লাগানো হয়।
এরমধ্যে জুড়ি রেঞ্জে ২০০৮-২০০১১ অর্থ বছরে ১৮৯ হেক্টর, বড়লেখা রেঞ্জে ২০০৭-২০১১ অর্থ বছরে ১৭৯ হেক্টর, কমলগঞ্জের রাজকান্দি রেঞ্জে ২০০৮-২০১১ অর্থ বছরে ২০৭ হেক্টর, মৌলভীবাজার রেঞ্জে ২০০৮-২০১১ অর্থ বছরে ৮০ হেক্টর ও কুলাউড়া রেঞ্জে ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে ১০ হেক্টর।
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, গাছ চুরি, স্বল্পসময়ে আয়ের লক্ষ্যে আগর বাগান উজাড় করে লেবু চাষের কারণে অর্ধেকের কম বাগান টিকে আছে বর্তমানে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট বন বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৮ সালের প্রকল্পটি ছিলো পরীক্ষামূলক। আর ২০০৬ সালের প্রকল্পের বেশিরভাগ ছিলো সামাজিক বনায়নের আওতায়। বর্তমানে ৭০ ভাগ বাগান টিকে আছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বাগান তৈরিতে কত টাকা ব্যয় হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে ১ হেক্টর জমিতে বনায়নের জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। আগরের ক্ষেত্রেও হিসেবটা প্রায় কাছাকাছি। তবে আগে খরচটা কম ছিল।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষ বিভাগের তথ্যমতে, তাদের অধীন বনে ২০০৬ সালের প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজার সদর রেঞ্জ, শ্রীমঙ্গল এবং হবিগঞ্জের সাতছড়ি রেঞ্জ মিলে মোট ৪২৫ হেক্টর জমিতে আগর বনায়ন করা হয়। মৌলভীবাজারের দুটি রেঞ্জে ৩১০ হেক্টরের বাগান করা হয়। এরমধ্যে কালাছড়া বিটে ১৩০ হেক্টর, চাউতলী বিটে ৬০ হেক্টর এবং বর্ষিজোড়ায় ১২০ হেক্টর।
এরমধ্যে ১৩ লাখ ২০ হাজা টাকা ব্যয়ে বর্ষিজোড়া ক্যাম্পে লাগানো আগর বাগানটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হিসেবে উল্লেখ করেছে তারা। এই বাগানের কোনো গাছই আর অবশিষ্ঠ নেই। আর বাকি বাগানের মাত্র ৩০ ভাগ টিকে আছে।
আগর বাগান উজাড়ের বিষয়ে বন কর্মকর্তারা জানান, সামাজিক বনায়নের ক্ষেত্রে বাগান পরিচর্যা করেন উপকারভোগীরা। স্বল্পসময়ে বেশি লাভের জন্য তারা লেবুর চাষ করেছেন।
সেক্ষেত্রে বন বিভাগের কোনো দায় ছিল কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, চারা রোপণের দু’বছর পর্যন্ত পরিচর্যার জন্য বন বিভাগের বাজেট থাকে। পরবর্তীতে তদারকির অভাবে উপকারভোগীরা নিজেদের মতো বাগান ধ্বংস করে লেবু চাষ করেছেন।
তবে উপকারভোগীরা দায়ি করছে বনবিভাগকে। শ্রীমঙ্গলের কালাপুর এলাকার বাসিন্দা বাগানের উপকারভোগী হারিস মিয়া ও ফারুক হোসেন বলেন, বন বিভাগের যে পরিমাণ চারা রোপণের কথা ছিলো সে পরিমাণ তারা রোপণ করেনি। তাছাড়া চারা রোপণের পরই অনেক চারা মারা যায়। সেখানে পূণরায় চারা রোপণ না করায় জায়গা খালি পড়ে ছিল। সেইসব খালি জায়গায় তারা সাথী ফসল হিসেবে লেবুসহ ফলের গাছ লাগিয়েছেন।
তাদের অভিযোগ, চারা লাগানোর পর বন বিভাগ তাদের কোনো ধরনের সহায়তা করেনি। যেটুকু টিকে আছে তা তাদের কারণে।
বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সদ্য বিদায়ী শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন বলেন, লেবু সাথী ফসল নয়। বন বিভাগ আগর বা অন্যান্য বনায়নে সাথী ফসল হিসেবে আদা হলুদ মরিছের মতো ছোট ফসলকে সাথী বা সহায়ক ফসল হিসেবে অনুমতি দেয় যা মূল গাছ বা বাগানের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু আগর বাগানের উপকারভোগীরা সেটা মানেনি।
বনবিভাগ জানায়, প্রতি হেক্টর আগর বাগান সৃজনের জন্য তখন ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার টাকা। সে হিসেবে দুটি প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজারে মোট ১১৮৭ হেক্টর জমিতে চারা লাগাতে (রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদে) খরচ হয় প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রাকৃতিকভাবে ১২-১৫ বছরে আগর গাছ উৎপাদন উপযোগী হয়। পূর্ণবয়স্ক ১টি গাছ থেকে ৯ ঘণফুট কাঠ পাওয়া যাবে যা থেকে ২৫ গ্রাম আতর উৎপাদন হয়।
এক তোলা (১১.৬২ গ্রামে তোলা) আগর বিক্রি হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকায়। তেল আহরণের পরে কাঠও বিক্রি হয়। প্রতিকেজি সাধারণ কাঠ ১০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। পূর্ণবয়স্ক একটি গাছের ন্যূনতম মূল্য ২০ হাজার টাকা।প্রতি হেক্টর জমিতে আড়াই থেকে তিন হাজার চারা লাগানো হয়। সেই হিসেবে ১৫ বছর পর প্রতি হেক্টর জমির গাছের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন জানান, সামাজকি বনায়নের শর্তটাই হচ্ছে উপকারভোগীরা বন রক্ষায় কাজ করবে বন বিভাগের সঙ্গে। আগর বাগানে অন্য কিছু করতে পারবেন না। এই মুহূর্তে সব কাগজ হাতে নেই। সবগুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
এফএ/পিআর