জুতা পরে থানায় ঢোকা মানা!
রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ হুজরীপাড়া ও দর্শনপাড়া ইউনিয়ন। এক সময় জেলা পুলিশের আওতাধীন ছিল এই এলাকা। থানার দূরবর্তী এই এলাকার গ্রামগুলোর বাসিন্দারা পুলিশি সেবা পাচ্ছিলেন না সেইভাবে। এতে ভোগান্তি বাড়ছিল মানুষের। শহর ছেড়ে গ্রামের এই অংশে নগর পুলিশের (আরএমপি) সেবা পৌঁছাতে ২০১৮ সালের ১ মার্চ চালু হয় কর্ণহার থানা। একইসঙ্গে চালু হয় আরএমপির আরও নতুন সাত থানা।
পবা থানা ভেঙে গড়া কর্ণহার থানার সুফল ভালোই পাচ্ছিলেন এলাকাবাসী। কিন্তু সময়ের ফেরে ভোগান্তি বাড়ে মানুষের। এলাকার লোকজন বলছেন, এখন গ্রামের সেই থানায় গ্রামবাসীদেরই ঢোকা বারণ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলী তুহিন থানায় বসবাস করেন। থানাকে তিনি নিজের বাড়ি বানিয়ে রেখেছেন। থানায় প্রবেশের আগেই ডিউটি অফিসার পথ আটকে দেয়। করোনা পরিস্থিতির অজুহাতে লোকজনের থানায় ঢোকা কারণ করে দিয়েছেন ওসি আনোয়ার আলী তুহিন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাউকে জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে থানায় প্রবেশ করতে দেন না ওসি। অথচ জুতা পরে দিব্যি আসা যাওয়া করছেন পুলিশ সদস্যরা। আবার থানায় ঢোকার আগে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই। থানায় দালাল ছাড়া কারও সঙ্গে কথাও বলেন না ওসি।
ছোটখাটো যেসব বিষয় স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করা যায়, সেসব বিষয়ে অভিযোগ নেন ওসি তুহিন। এরপর তদন্তের নামে ডেকে দেন থানায়। পরে দালালের মাধ্যমে থানায় মিমাংসার নামে অর্থ আদায় করেন।
গত ১৩ আগস্ট কর্ণহার থানার তেঁতুলিয়া এলাকার কৃষক কাউসার আলীর শিমখেত নষ্ট করেছিলো প্রতিবেশী কুড়হানের ছাগল। ওই কৃষক ছাগল আটকে রাখায় থানায় অভিযোগ দেন থানার দালাল হিসেবে পরিচত কুড়হান।
পরে পুলিশ কাউসার আলীকে থানায় ডেকে সালিশের নামে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় যৌন হয়রানির মামলা দিয়ে কাউসারকে আদালতে তোলেন ওসি। ২ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে সেই মামলা নিষ্পত্তি হয় কাউসারের।
সম্প্রতি থানা এলাকার এক ছাত্র প্রতিবেশীর একটি হাঁস মেরে ফেলে। এনিয়ে ওই ছাত্রের নামে থানায় অভিযোগ এলে ওসি ওই ছাত্র ও তার বাবাকে তদন্তের নামে থানায় ডেকে নেন। পরে তাদের জিম্মি করেন ওসি।
দারুশা এলাকার এক নারীর রান্নাঘরে ঢুকে ভাত খেয়ে নেয় প্রতিবেশীর ছাগল। এনিয়ে ওই নারী থানায় অভিযোগ দেন। পরে ওসি ছাগলের মালিককে থানায় ডেকে মিমাংসার নামে হয়রানি করেন বলেও জানা গেছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ছোট খাটো এমন অনেক বিষয়ে ওসি মামলা নিয়ে নেন। পরে হয়রানি করেন। কখনও কখনও জিম্মি করে অর্থ আদায় করেন। আর এই পুরো প্রক্রিয়ায় তাকে সহায়তা করেন থানার কয়েকজন দালাল।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার দুপুরের পর কর্ণহার থানায় প্রবেশ করতেই ডিউটি অফিসার এএসআই নিভা রাণী আটকে দেন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও তিনি বলেন, ওসির নির্দেশ, জুতা নিয়ে থানায় ঢোকা যাবে না।
হাত-পা ধোয়ার ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে জানান, নেই। থানা পুরো অপরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও এমন নির্দেশনা কেন জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিউটি অফিসার।
থানার পাশেই হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ। সেখানে কথা হয় পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার সঙ্গে।
থানায় গ্রামবাসীর ঢোকা বারণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওসি তার নিজের মতো করে থানা চালান। এনিয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই। তবে এটি গ্রামীন এলাকার থানা। কেউ স্যান্ডেল পরে, কেউ জুতা পরে আবার কেউ খালি পায়ে থানায় যাবেন। সবার প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এ থানায় সেসব নেই।
জনগণকে হয়রানির বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, তার সঙ্গে ওসি কথা বলেন না। স্থানীয় কোনো বিষয় নিয়ে তিনি তার সহায়তাও নেন না। থানার কোনো পুলিশ সদস্য ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুক এটিও চান না ওসি তুহিন।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণহার থানার ওসি আনোয়ার আলী তুহিন বলেন, শতভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে এখানে দায়িত্বপালন করছে পুলিশ। সালিশের নামে এতদিন হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন লোকজন। সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতেই হয়ত ক্ষুব্ধ কিছু মানুষ। পুলিশ জনগণের জন্য সবসময় কাজ করছে।
থানায় প্রবেশে বাধা দেয়ার বিয়ষটিও ভিত্তিহীন। কেবল করোনার কারণে বাড়তি সর্তকতা হিসেবে প্রবেশের কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এটি সুরক্ষার জন্যই করা হয়েছে। এনিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। সুরক্ষা মেনেই লোকজন সেবা নিচ্ছেন থানায়।
এই বিষয়ে নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, এনিয়ে তার কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/এমএস