ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দফায় দফায় বন্যায় মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে বরেন্দ্র কৃষকের

ফেরদৌস সিদ্দিকী | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৮:৩৬ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২০

এ নিয়ে তিন দফা বন্যা। কোথাও কোথাও চার দফা। এখনও পানির নিচে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। এতে কোমর ভেঙেছে দেশের শষ্যভাণ্ডার খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রণোদনায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। কিছুতেই সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে জানান কৃষকরা।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭১ হেক্টর জমিতে ফসল ছিল কৃষকের। শ্যামল ফসলে স্বপ্নজাল বুনছিলেন বরেন্দ্র কৃষক। মাঠে দুলছিল ৩ লাখ ৯৬ হাজার ২২৫ হেক্টর রোপা আমন। সবজি ছিল ৭ হাজার ৪৩১ হেক্টরজুড়ে। ২৬ হজার ৯৬১ হেক্টরে ছিল মাশকালাই। পানবরজ ছিল চার হাজার ৭৫৪ হেক্টরে।

দফায় দফায় বন্যার পরও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন সংগ্রামী কৃষক। কিন্তু কৃষকের সেই স্বপ্ন ডুবছে অতি বৃষ্টি ও অকাল বন্যায়।

গতকাল রোববার পর্যন্ত তলিয়ে রয়েছে ১৪ হাজার ৫৪৯ হেক্টর ফসলি ক্ষেত। এর মধ্যে রোপা আমন তলিয়ে রয়েছে ১১ হাজার ৪৮৫ হেক্টর। তলিয়ে রয়েছে ২৪০ হেক্টর সবজি ক্ষেত। এছাড়া ২ হাজার ৮০৫ হেক্টর মাশকালাই এবং ১৯ হেক্টর পানেরবরজ ডুবে গেছে এই দফা বন্যায়।

কৃষি দপ্তর আরও জানিয়েছে, অকাল বন্যায় এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ফসলি ক্ষেত ডুবে রয়েছে নওগাঁ জেলায় ৬ হাজার ৭২৭ হেক্টর। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ হাজার ৭১৫ হেক্টর, নাটোরে ৩ হাজার ৫৬১ হেক্টর এবং রাজশাহীতে ৫৪৬ হেক্টর। পানি নামতে বিলম্ব হলে ক্ষেতের পুরো ফসলই হারাবেন কৃষক।

অন্যের এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে পানেরবরজ গড়ে তুলেছিলেন রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল এলাকার পানচাষি আশরাফ আলী। দীর্ঘদিন ধরেই পান চাষ করে আসছেন তিনি। দুটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি পান চাষ করছিলেন। কিন্তু অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে তার বরজ। আগেও এক দফা ডুবেছিল বরজ। তাতে কিছুটা বাঁচলেও এবার আর রক্ষা নেই। এলাকার শত শত পান চাষির মরণদশা।

আশরাফ আলী জানান, পান এলাকার চাষিদের কাছে সোনা। এক বিঘা বরজ থেকে খরচা বাদে তার আয় হয় দেড় লাখ টাকা। এ নিয়ে তার সংসার চলে। সন্তানদের পড়ালেখাও চলছিল। ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করে আসছিলেন বরজ থেকেই। কিন্তু এবার আর হচ্ছে না। বিকল্প চাষাবাদেরও ব্যবস্থা নেই। নতুন করে বরজ শুরু করতে ফের তাকে এনজিও ঋণ নিতে হবে। একই ভাষ্য এলাকার অন্য পানচাষিদেরও।

Rajshahi

এ পরিস্থিতি থেকে কৃষকদের বের করে আনতে সরকারের প্রণোদনা জরুরি বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ৬০ শতাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। সুতরাং ক্ষতি যখন হয় তখন ধরে নিতে হবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন এমন একটা সময়, তাতে ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই ঋণ নিয়ে যারা ফসল চাষ করেছেন তাদের ঋণের কিস্তি মওকুফ করে দিতে হবে। তারা যেন রবিশষ্য চাষ করে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে এজন্য প্রণোদনারও ব্যবস্থা করতে হবে।

দাদন নিয়ে ফসল চাষে নামা কৃষকদের উপায় তবে কি? জানতে চাইলে এ অধ্যাপক বলেন, এটি আসলে মহাজনি ব্যবসা। সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেও কিছু করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত কৃষককে আমরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বি করে তুলতে না পারছি। আসলে দাদনভোগি মহাজন ও কৃষকের মধ্যে একটা সম্পর্ক থেকেই যায়। যখন কৃষক আর্থিক সংকটে পড়েন, তখন ঘুরেফিরে আবারও মহাজনের কাছে যান। এটি থেকে কৃষক রক্ষা পাবেন না। এ নিয়ে আমাদের ভিন্ন পথে এগোতে হবে।

জানতে চাইলে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন ফসল চাষ করে সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন কৃষক। কিন্তু সেই ফসলও ডুবে গেছে। দিন কয়েকের মধ্যে পানি না নামলে অন্তত ২০ শতাংশ ফসল বাঁচবে। না হলে সব শেষ।

বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উল্লেখ করেছেন নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, নানান কারণে এবার বর্ষা প্রলম্বিত হয়েছে।

নওগাঁ এ নিয়ে চতুর্থ দফা বন্যার কবলে। অতিবৃষ্টির ফলে এ বন্যা। এর ক্ষতি থেকে কৃষককে রক্ষার আসলে কোনো প্রযুক্তি নেই। বন্যা নেমে গেলে উচ্চফলনশীল জাতের রবিশষ্য এবং সবজি চাষ করে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন। তালিকা তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা হবে বলেও জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এবারের প্রথম দফায় বন্যায় রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৩৯৮ দশমিক ৬৪ হেক্টর ক্ষেতের ফসল। এতে উৎপাদন হারিয়েছে ১৯ হাজার ৯৯৫ দশমিত ৭৫ টন। টাকার অংকে এ ক্ষতির পরিমাণ ৭৬ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার। প্রথম দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৮৯৮ জন কৃষক।

দ্বিতীয় দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৮০ হাজার ৯১৫ জন কৃষক। এতে ক্ষতি হয়েছে ৮ হাজার ১০৪ দশমিক ৯০ হেক্টর ক্ষেতের ফসল। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ ১০২ কোটি ৫৭ লাখ ৬১ হাজারের মতো।

আগের দুই দফা বন্যায় ৭৩ হাজার ৪৪ জন কৃষকের ৯ হাজার ৮৬৭ দশমিক ৩০ হেক্টর রোপা আউস নষ্ট হয়েছে। ৭৪৮ দশমিক ৪০ হেক্টর আমন বীজতলা হারিয়েছেন ৩১ হাজার ৯০২ কৃষক। ৪ হাজার ১১১ জন কৃষকের ৬১৯ হেক্টর রোপা আমন এবং ১১ হাজার ৮৭০ জন কৃষকের ৩ হাজার ৫১১ দশমিক ৪০ হেক্টর বোনা আমন ক্ষেত নষ্ট হয়েছে।

এছাড়া ১২ হাজার ৬৯৫ জন কৃষকের ৫৭৬ দশমিক ১৪ হেক্টর সবজি, ৪৫ জন কৃষকের ১৫ হেক্টর ভুট্টা, এক হাজার ৭০ জন কৃষকের ২৪ হেক্টর মরিচ, ৫ হাজার ৪২৭ জন কৃষকের ১০ দশমিক ৬৫ হেক্টর আখ, এক হাজার ৯৯ জন কৃষকের ৪৫ দশমিক ৩০ হেক্টর পান বরজ এবং ৫৫০ জন কৃষকের ৭৭ হেক্টর পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/পিআর