দিনে এক লাখ কেজি মাল্টা বিক্রি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবী। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে মহামারির এই দুঃসময়েও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়েছে মাল্টার চাহিদা। দৈনিক এক লাখ কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলের আড়তগুলাতে।
চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ফল খেতে বলছেন। এর ফলে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ মাল্টার চাহিদা বেড়ে এখন দ্বিগুণ হয়েছে। আর তাই এবারের মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মাল্টা চাষিরা প্রায় ১০ কোটি টাকার মাল্টা বিক্রির আশা করছেন।
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত তিন-চার বছর ধরে বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে মাল্টা চাষ হচ্ছে। চলতি মৌসুমে বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর, হরষপুর, সিঙ্গারবিল ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ৫০ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ করছেন স্থানীয় চাষিরা। বর্তমানে বিজয়নগরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দেড়শ মাল্টা বাগান রয়েছে। প্রতিটি বাগানেই চাষ হচ্ছে সবুজ রঙা বারি-১ ও বারি-২ জাতের কয়েক লাখ টাকার মাল্টা। এবারের মৌসুমে বিজয়নগরের মাল্টা বাগানগুলোতে উৎপাদন আটশ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা কৃষি বিভাগের।
মাল্টা চাষের জন্য কৃষি অফিস থেকেই বিনামূল্যে চাষিদের চারা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। মৌসুমি এ ফল চাষে খরচও তুলনামূলক কম। আর ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারগুলোতে বিজয়নগরে উৎপাদিত মাল্টার চাহিদাও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে একটু বেশি। তবে কৃষকরা দেশীয় মাল্টার বাজার ধরে রাখতে বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের মাল্টাচাষি আলমগীর মিয়া বলেন, আমার তিন বিঘা জমিতে এবারের মৌসুমে প্রায় সাত টন মাল্টা উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। করোনাভাইরাসে আমাদের ব্যবসায় কোনো প্রভাব পড়েনি, উল্টো মাল্টার চাহিদা আরও বেড়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের বাসিন্দা মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী মো. মশিউর রহমান জানান, বাজারে মাল্টার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবারের মৌসুমের জন্য সাড়ে চার লাখ টাকায় খাটিঙ্গা গ্রামের একটি মাল্টা বাগান কিনেছেন। এ বাগান থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।
বিজয়নগর উপজেলার আউলিয়া বাজারের ফল ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানান, এখন দোকানে মাল্টা না থাকলে ক্রেতাও কম আসে। অন্যসব ফলের চেয়ে মাল্টা বিক্রি হচ্ছে বেশি। বিশেষ করে ফরমালিনমুক্ত হওয়ায় বিজয়নগরের ফলের দোকানগুলোতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে স্থানীয় উৎপাদিত মাল্টার চাহিদা বেশি।
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. খিজির হোসেন প্রামাণিক বলেন, বিজয়নগরের জন্য মাল্টা খুবই সম্ভাবনাময় একটি ফল। গত মৌসুমে বিজয়নগরে প্রায় পাঁচশ মেট্রিক টন মাল্টা উৎপাদিত হয়েছিল। এবারের মৌসুমে উৎপাদন বেড়ে আটশ মেট্রিক টান ছাড়িয়ে যাবে এবং সামনের মৌসুমে উৎপাদন আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, চাষিরা এখন মাল্টা চাষে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে আগামী মৌসুম থেকে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকরণের পাশাপাশি বিদেশেও মাল্টা রফতানি করা সম্ভব হবে।
ফল ব্যবসায়ীরা জানান, করোনাভাইরাসে উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেও মাল্টা ফলের বেচাকেনা বেড়েছে। মহামারির প্রকোপ শুরুর আগে জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি হতো। লকডাউনের পর থেকে বেচাকেনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে এক লাখ কেজির বেশি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফলের আড়তগুলোতে। বাজারে দেশীয় সবুজ রঙা মাল্টা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। আর বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৭০ টাকা দরে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও সরাইল-বিশ্বরোড ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও থ্রী স্টার ফলের আড়তের সত্ত্বাধিকারী এস কে লিটন ফরাজী বলেন, গত জুন মাসের পর থেকে মাল্টার বেচাকেনা বেড়েছে। এখন দিনে এক লাখ কেজির বেশি পরিমাণ মাল্টা বিক্রি হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সুস্থ মানুষের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিভিন্ন পুষ্টিকর ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে লেবু, আমলকি, মাল্টা, কমলা ও আমড়ার মতো ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফলগুলো আক্রান্তদের জন্য দারুণ উপকারী।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ্ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আমরা সর্বপ্রথম স্বভাবিক খাবার খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলি। এরপর শারীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর ও ভিটামিন সমৃদ্ধ অন্যান্য খাবার পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার জন্য বলা হয়।
ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ লেবু, মাল্টা, কমলা, বাতাবি লেবু, আমলকি ও আমড়ার মতো ফলগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর ফলের ক্ষেত্রে দেশীয় ফল খাওয়াই ভালো, কারণ বিদেশি ফলে নানা ক্ষতিকারক ক্যামিকেল থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এফএ/পিআর