ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

করোনায় মৃত ভাইয়ের লাশ দাফনে বাধা দিয়ে এখন কাঁদছেন ভাই

নিজস্ব প্রতিবেদক | ময়মনসিংহ | প্রকাশিত: ০৩:২৯ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বহু অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে মানুষ; এখনও হচ্ছে। করোনায় মারা গেলে লাশ দাফনে বাধা, মসজিদের খাটিয়া না দেয়া, ইমাম জানাজা পড়ালে ইমামতির দায়িত্ব হারানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।

করোনায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও প্রাণভয়ে অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েছেন। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পরিবারসহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। করোনায় আক্রান্ত বৃদ্ধ মা-বাবাকে বনে ও রাস্তায় ফেলে যাওয়া। করোনা আক্রান্ত স্বজনদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। করোনা সন্দেহে বৃদ্ধা মাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন ছেলেরা। মানবিক কাজ করা ও ভাড়া দিতে না পারা ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বর্তমানে এসব অমানবিক ঘটনা কমেছে। করোনার ভয়ও অনেকটা কমে গেছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে।

করোনার আতঙ্কে যে বা যারা মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করেছেন ও লাশ দাফনে বাধা দিয়েছেন কিংবা সামাজিকভাবে বয়কট করেছেন তারা এখন অনুতপ্ত। কেউ কেউ এসব ঘটনার জন্য আফসোস করছেন। করোনাকালে ঘটে যাওয়া এমন একটি ঘটনার জন্য অনুতপ্ত ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার ৫ নম্বর সাতুতি ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুল হাইয়ের ভাইয়েরা।

গাজীপুরের স্কয়ার মাস্টার বাড়ি এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন আব্দুল হাই। সেখানে তার করোনার উপসর্গ দেখা দিলে ৩ মে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার পথে মারা যান আব্দুল হাই। করোনায় মারা গেছে ভেবে লাশ নিয়ে এলাকায় আনতে বাধার মুখে পড়েন স্বজনরা।

অ্যাম্বুলেন্স গ্রামে ঢুকতে বাধা দেন এলাকাবাসী ও ভাতিজারা। কোনোভাবেই লাশ নামতে না দিয়ে মৃতের স্ত্রী-সন্তানকে মারধর করা হয়। বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয় ছেলেকে। লাশ দাফনের অনুমতি চাইতে মামার বাড়ি গিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়। এ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সচালক লাশ গাড়ি থেকে নামিয়ে রেখে চলে যান। লাশ ভ্যানে নিয়ে রাতভর গৌরীপুরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘোরেন স্ত্রী-সন্তান। খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসন এলাকাবাসী ও স্বজনদের বুঝিয়ে ৫ মে লাশ দাফন করেন।

jagonews24

সেদিন কেন ভাইয়ের লাশ বাড়িতে ঢুকতে দেননি এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল হাইয়ের ভাই আব্দুল কাশেম বলেন, আমরা তো জানতাম না আমার ভাই কীভাবে মারা গেছে। তখন করোনার ভয় ছিল। এলাকাবাসীও আমাদের ভয় দেখিয়েছে। এলাকায় লাশ ঢুকলে মানুষ মারা যাবে বলেছিল তারা। তাই আমার ভাইয়ের লাশ বাড়িতে ঢুকতে দেইনি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেজুতি ধর ও পুলিশ সবাইকে বুঝিয়ে লাশ দাফন করে। আগে যদি জানতাম তাহলে এমন করতাম না। আমরা আমার ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করেছি। এমন অন্যায় যেন আর কেউ না করে। আমরা অনুতপ্ত।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অপর ভাই আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমরা ভাইয়ের প্রতি অন্যায় করেছি। আমার ভাই যদি আমাদের মাফ না করে আল্লাহও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমি সেদিনের ঘটনার জন্য লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। ভাইয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছি। ক্ষমা করে দিস ভাই। দোয়া করি আল্লাহ তোকে জান্নাত দান করুক।

একই ঘটনায় এলাকাবাসীও দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন সেদিন ভুল করেছেন। প্রতিবেশী উজ্জ্বল মিয়া বলেন, এটি খুব বেদনাদায়ক ঘটনা। এ ঘটনায় আমরা এলাকাবাসী অনুতপ্ত।

স্থানীয় বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে যা হয়েছে, তা অন্যায়। এমন যেন আর কেউ না করে সেজন্য এলাকাবাসীকে সচেতন করেছি আমি।

গৌরীপুর পৌরসভার ৫ নম্বর সাতুতি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আতাউর রহমান বলেন, করোনায় মৃত আব্দুল হাইয়ের লাশ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি- এমন খবর পাওয়ার পর গভীর রাতে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় পৌরসভার কবরস্থানে দাফন করা হয়। এটি গৌরীপুরের জন্য একটি কলঙ্কিত ঘটনা। এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য এলাকাবাসীকে সচেতন করা হয়েছে। এ ঘটনার পর তার পরিবার ও এলাকাবাসী অনুতপ্ত।

jagonews24

গৌরীপুর থানা পুলিশের ওসি মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ বাড়িতে ঢুকতে না দেয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছি। পরিবারকে বুঝিয়ে সবার উপস্থিতিতে লাশ দাফন করেছি। করোনা সংক্রমণের শুরুতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার জন্য এখন অনুতপ্ত এলাকাবাসী ও মৃতদের স্বজনরা।

ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন এবিএম মসিউল আলম বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী করোনা মোকাবিলায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে কাজ করছি। করোনা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছি। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এখনও কাজ করে যাচ্ছি। তবে করোনার সংক্রমণ শুরুর প্রথমে গৌরীপুর, ত্রিশাল ও ফুলপুরে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে নজর রাখছি।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ৩১ দফা নির্দেশনা মেনে ওয়ার্ড পর্যায় থেকে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যন্ত মানুষকে সচেতন করার কাজ করছি আমরা। করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছি। যে কারণে আমরা সঠিকভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পেরেছি। সচেতনতার অভাবে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনা আর যেন না ঘটে সেজন্যও কাজ করছি আমরা।

এএম/এমএস