সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির ৩৯ অভিযোগ
সরকারি ফি’র বাইরে ঘুষ না দিলে কোনো কাজ হয় না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। দলিলের নকল তুলতে সরকারি ফি ২৭০ টাকার বিপরীতে সেবাগ্রহীতাদের গুনতে হয় দেড় হাজার টাকা। সরকারি ফি’র বাইরে পুরো টাকাই যায় সাব-রেজিস্ট্রার মো. মিজাহারুল ইসলামের পকেটে। তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির এমন ৩৯টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করে ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ১২ জন ভুক্তভোগীর করা ওই অভিযোগে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী সাইফুল ইসলামের দুর্নীতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সাব-কবলা দলিলের মূল্য এক হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হলে সরকারি ফি’র বাইরে সেরেস্তা বাবদ আড়াই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। যদি দলিলের মূল্য এক লাখ টাকা বা অধিক মূল্য হয় তাহলে প্রতি লাখে ৩০০ টাকা করে বেশি দিতে হয়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের হেবা ঘোষণা দলিলের মূল্য যতই হোক না কেন, সরকারি ফি ৬৫০ টাকা। কিন্তু এক হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হলে তিন হাজার ৩০০ টাকা সেরেস্তা বাবদ ঘুষ দিতে হয় সেবাগ্রহীতাদের। এক লাখ টাকার বেশি মূল্য হলে প্রতি লাখে অতিরিক্ত আরও ৩০০ টাকা করে নেয়া হয়।
একইভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের দানের ঘোষণা দলিল মূল্যের ওপর সরকার নির্ধারিত ফিও ৬৫০ টাকা। কিন্তু এক হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হলে তিন হাজার ৩০০ টাকা সেরেস্তা বাবদ ঘুষ দিতে হয়। এছাড়া এক লাখ টাকার অধিক মূল্য হলে প্রতি লাখে দিতে হয় অতিরিক্ত আরও ৩০০ টাকা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগে আরও বলা হয়, বিনিময় দলিল করতে ব্যাংক চালানের পরও অতিরিক্ত চার-পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে সাব-রেজিস্ট্রার মিজাহারুলকে। বণ্টননামা এবং অসিয়ত দলিলের মূল্যের ওপরও অতিরিক্ত ১ শতাংশ হারে ঘুষ নেন তিনি।
এসএ এবং বিএস খতিয়ান যদি তহসিল অফিসের হয় তাহলে সাব-রেজিস্ট্রারকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। যদিও তহসিল অফিসের এসব খতিয়ান দিয়ে দলিল না করতে প্রজ্ঞাপন জারি রয়েছে। এছাড়া দলিলের মূল কপি ছাড়া দলিল করতে গ্রাহক ফটোকপি নিয়ে আসলে সাব-রেজিস্ট্রারকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসএ এবং বিএস খতিয়ানের সার্টিফিকেট কপি জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম থেকে সংগ্রহ করার পরও দলিল করতে গেলে ‘এটি সঠিক নয়’ জানিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেন সাব-রেজিস্ট্রার মিজাহারুল।
দলিল লেখকের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রারের খাস কামরার দরজা বন্ধ করে প্রতিজনের সঙ্গে আলাদাভাবে প্রতিটি দলিলের জন্য আলাদা আলাদা চুক্তি করতে হয়। খাস কামরায় থাকা নৈশপ্রহরী সাইফুলকে দিয়ে দলিল লেখকদের সঙ্গে টাকা লেনদেন করেন সাব-রেজিস্ট্রার। নৈশপ্রহরী সাইফুল ইসলামের দায়িত্ব রাতে হলেও সারাদিন সাব-রেজিস্ট্রারের সঙ্গে থাকেন ঘুষ লেনদেনের জন্য।
মো. সালাহ উদ্দিন নামে এক দলিল লেখক সাব-রেজিস্ট্রারের ঘুষ-দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তাকে বহিষ্কারের জন্য অন্য দলিল লেখকদের কাছ থেকে সাব-রেজিস্ট্রার জোরপূর্বক স্বাক্ষর আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় এমপি ফরহাদ হোসেন সংগ্রামকে প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দিতে হবে বলে দলিলের সেরেস্তা বাবদ ঘুষ বাড়ানো হয়। কিন্তু এমপি সৎ মানুষ জানিয়ে সালাহ উদ্দিন প্রতিবাদ করলে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে হুমকি দেন সাব-রেজিস্ট্রার। এ সময় সাব-রেজিস্ট্রার ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘টাকা কি আমার পকেট থেকে দেব নাকি? এমপিকে টাকা দিতে দিতে ফকির হয়ে গেছি।’ এ ঘটনার পর দলিল লেখক ও নৈশপ্রহরী সাইফুলকে দিয়ে সালাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি করান সাব-রেজিস্ট্রার মিজাহারুল।
সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের একজন নাসিরনগর উপজেলা সদরের বাসিন্দা মিহির দেব বলেন, চার-পাঁচ মাস আগে আমি একটি বাড়ির দলিল করতে গিয়েছিলাম সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। সাব-রেজিস্ট্রার আমার কাছে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন। পরে ২০ হাজার টাকা দিয়ে দলিল করেছি।
আরেক অভিযোগকারী ও দলিল লেখক মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় আমার লাইসেন্স বাতিলের জন্য অন্য দলিল লেখকদের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নিয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার। স্বাক্ষর না দিলে কারও দলিল রেজিস্ট্রি করবেন না বলে হুমকি দেন।
এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে নাসিরনগর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার মিজাহারুল ইসলাম বলেন, আপনারা অভিযোগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করেন। যদি সত্য হয় তাহলে অবশ্যই আমার বিরুদ্ধে এ নিয়ে লিখবেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রেজিস্ট্রার আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, তার (মিজাহারুল) অফিসে কিছু জটিলতা তৈরি হওয়ায় এগুলো হচ্ছে। তারপরও অভিযোগগুলো আমরা তদন্ত করে দেখব। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেব।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খান বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো আমরা যাচাই করে দেখছি। সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আজিজুল সঞ্চয়/এএম/জেআইএম