ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

সেলাই মেশিন চালিয়ে ছেলেকে দেশসেরা বিসিএস ক্যাডার বানালেন মা

আকরামুল ইসলাম | সাতক্ষীরা | প্রকাশিত: ১০:১৮ পিএম, ০১ জুলাই ২০২০

অভাবের সংসার ছিল তারাপদ সরকারের। মাছের ব্যবসা করতেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ কিনে বিক্রি করতেন হাটবাজারে। সেই মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে চলতো সংসার ও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া।

২০০৬ সালে হঠাৎ দুর্যোগ নেমে আসে তার পরিবারে। সাতক্ষীরার ত্রিশমাইল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারাপদ সরকার। এতে বেসামাল হয়ে পড়ে তার পারিবার। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়।

বাবা মারা যাওয়ার পর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন ছেলে লালটু সরকার। সেলাই মেশিন চালিয়ে ছেলেকে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন মা। পাশাপাশি টিউশনি করেছেন লালটু। সেদিনের লালটু সরকার ৩৮তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সারাদেশের মধ্যে তার সাবজেক্টে তৃতীয় হয়েছেন।

লালটু সরকার সাতক্ষীরার তালা সদরের মাঝিয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা। ভাই-বোনের মধ্যে লালটু ছোট। বড় বোন দিপালী সরকার থাকেন স্বামীর বাড়ি। মা সুলতা সরকার থাকেন গ্রামে বাবার রেখে যাওয়া কুঁড়েঘরে।

মঙ্গলবার (৩০ জুন) ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশ হয়েছে। ফলাফলে লালটু সরকার সারাদেশের মধ্যে তার সাবজেক্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। বুধবার (০১ জুলাই) সন্ধ্যায় জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপ হয় লালটু সরকার ও তার মা সুলতা সরকারের। এ সময় অসহায় হয়ে পড়া দিনগুলোর কথা বলে আবেগাপ্লুত হন মা-ছেলে।

সুলতা সরকার বলেন, ২০০৬ সালে লালটুর বাবা মারা যাওয়ার পর খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। দিন চলত না ঠিকমতো। খেয়ে না খেয়ে থেকেছি। এরপর একটি বেসরকারি সংস্থা একটি সেলাই মেশিন দেয়। সেই সেলাই মেশিনে হাতের কাজ করে উপার্জনের টাকা দিয়ে সংসার চলত। ছেলে লেখাপড়া শিখত। খুব বেশি খরচ ছেলেকে কোনো দিন দিতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছি সাধ্যমতো। ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। তবে এটি কী জিনিস আমি বুঝি না। ছেলে বলেছে ভালো চাকরি পেয়েছে। আমাদের আর অভাব থাকবে না। খুব খুশি হয়েছি। ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।

লালটু সরকার ২০০৭ সালে তালা বিদে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৪ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০০৯ সালে তালা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহাবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০১৩ সালে অনার্স ও ২০১৪ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

অসহায়ত্বের দিনগুলোর কথা তুলে ধরে লালটু সরকার বলেন, এসএসসি পরীক্ষার এক বছর আগে বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তবে লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। অভাবের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। এইচএসসি শেষ করে তালা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে চারটি টিউশনি করেছি। সেই টাকায় শেষ করেছি লেখাপড়া। মা-বোন সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে আমাকে। মা-ই আমার একমাত্র সম্বল।

লালটু সরকার বলেন, মাস্টার্স শেষ করার পর বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়েছি। বার বার ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি স্বপ্ন দেখতাম বিসিএস ক্যাডার হবো। ২০১৭ সালে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। পরীক্ষা দিয়েই বুঝেছিলাম আমার নাম আসবে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। এরপর দৈনিক ১৮-১৯ ঘণ্টা পড়ালেখা করতাম। অবশেষে শিক্ষা ক্যাডারে সারাদেশে তৃতীয় হয়েছি। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।

বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনুভূতি জানিয়ে লালটু সরকার বলেন, পরিশ্রম করলে সব সম্ভব। আমি চেষ্টা করেই আজ সফল হয়েছি। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় আমি খুব খুশি। এখন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমার ওপর আসা রাষ্ট্রের সরকারি দায়িত্ব পালন করতে চাই। সেজন্য সবার কাছে দোয়া চাই। তিনি বলেন, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার আগে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। এছাড়া বর্তমানে ফরিদপুরের সদরপুর মহিলা কলেজের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছি।

স্থানীয় বাসিন্দা তালা সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, পরিবারটি খুব অসহায়। মা খুব কষ্ট করে ছেলেটিকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। লালটু নিজেও অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে আজ বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এলাকার সুনাম বয়ে এনেছে। তার এমন ফলাফলে এলাকার মানুষ আনন্দিত।

আকরামুল ইসলাম/এএম/পিআর