ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

করোনা মোকাবিলায় গোড়ায় গলদ রাসিকের

ফেরদৌস সিদ্দিকী | প্রকাশিত: ১২:৫৮ এএম, ২৩ জুন ২০২০

রাজশাহী নগরীতে প্রাণঘাতি করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। প্রাণঘাতি করোনার উপসর্গ নিয়ে সোমবার মারা গেছেন চারজন। গতকাল রোববার মৃত্যু হয়েছে আরও চারজনের।

দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৭৮ দিন পর গত ১৫ মে রাজশাহী নগরীতে করোনা ধরা পড়ে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৪৪ জনের। দিন যতই গড়াচ্ছে বাড়ছে সংক্রমণ। ততই সামনে আসছে করোনা মোকাবিলায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) গলদ।

যদিও দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর রাজশাহী নগরীতেও করোনা ঠেকানোর তোড়জোড় শুরু হয়। জীবাণুনাশক ছিটাতে রাস্তায় নামেন স্বয়ং মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

নগরজুড়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিতরণ করা হয় মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবিক সহায়তা ছাড়া করোনা ঠেকাতে এখন দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই রাসিকের।

যদিও অবকাঠামো, জনবলসহ রাসিকের রয়েছে আলাদা স্বাস্থ্য দপ্তর। কিন্তু নমুনা সংগ্রহেই নামতে পারেনি রাসিকের স্বাস্থ্য দপ্তর। নগর ভবনেও নেই কোনো কার্যক্রম। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেখানে করোনার নমুনা সংগ্রহ করছেন।
আক্রান্তদের অভিযোগ, করোনা শনাক্তের পর তাদের নূন্যতম পরামর্শও দিচ্ছে না সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য দপ্তর। যোগযোগ করেও তারা সাড়া পাচ্ছেন না। সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকেও তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে না। নিজেরা যে যার মতো চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এ পরিস্থিতিতে ভরসা কেবল পুলিশ। করোনা শনাক্তের পর থেকেই পাশে রয়েছে নগর পুলিশ। বাড়ি লকডাউন ছাড়াও প্রয়োজনে বাজার করে দিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। সার্বক্ষণিক খোঁজখবরও নিচ্ছেন। চিকিৎসা ও পরামর্শ না পাওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ জনমনে।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্যবিধি মানাতেও নেই কার্যক্রম উদ্যোগ। ফলে দিনে দিনে নগরজুড়ে ভয়াবহ হচ্ছে করোনা সংক্রমণ। এই পরিস্থিতিতে পুরো দায় সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের উপর চাপাচ্ছে জেলার সিভিল সার্জনের দপ্তর।

রাজশাহীর প্রবীণ আহমেদ সফি উদ্দিন বলেন, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড পর্যায়ে কিছু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আছে। সিটি হাসপাতালও আছে।সিটি করপোরেশনের অর্থ আছে, পর্যাপ্ত জনবল এবং অবকাঠামো আছে। সেগুলোকে করোনা চিকিৎসার জন্য খুলে দেয়া জরুরি।প্রয়োজন হলে দ্রুত জনবল নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সংযোজন করা উচিত।

তিনি যোগ করেন, গত এক দশকে রাসিকের স্বাস্থ্য খাত চরম উপেক্ষিত রয়ে গেছে। এ বছর প্রায় হাজার কোটি টাকার বাজেট হয়েছে। তথাকথিত উন্নয়ন বাজেটের দরকার নেই, নজর দেয়া উচিত স্বাস্থ্য খাতেও।
গত ১৫ জুন করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী টেলিভিশন জার্নাালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান শ্যামলের। নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন তিনি।

তিনি জানান, করোনা শনাক্ত হবার দিন অনেক তদবিরের পর রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাকে একবার ফোন দিয়েছিলেন। এরপর বহু চেষ্টা করেও তার সাড়া পাননি। নূন্যতম কোনো পরামর্শ পাননি।

একই দশা করোনা আক্রান্ত রাজশাহীর আরও ৪ সাংবাদিকের। মেহেদি যোগ করেন, রাসিকের স্বাস্থ্য দপ্তরের সহায়তা না পেয়ে তিনি চরমভাবে হতাশ। বিষয়টি তিনি সিটি মেয়রকে অবহিত করেছেন।করোনা মোকাবেলায় সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য দপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে হতাশ মেয়রও।

গত ২০ জুন করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহীর তিন তরুণ সংবাদকর্মী আসাদুজ্জামান নূর, আবদুর রহিম ও মেহেদি হাসানের। নগরীর দড়িখড়বোনা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় তারা বসবাস করেন।

তারা জানান, করোনার উপসর্গ নিয়ে গত ১৩ জুন রাজশাহী খ্রিস্টিয়ান মিশন হাসপাতালে যান মেহেদি হাসান। নমুনা না নিয়ে সেখান থেকে তাদের সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
এর একদিন পর তারা কাউন্সিলর আবদুস সোবহানের সাথে যোগাযোগ করেন। এরও একদিন পর ১৫ জুন কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে একজন এসে তাদের তথ্য নিয়ে যান। এরপর নগর পুলিশসহ দফায় দফায় বিভিন্ন দল তথ্য নিতে এলেও নমুনা নিতে আসেননি কেউই। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৬ জুন তারা রাসিকের স্বাস্থ্য দপ্তরে যোগাযোগ করেন।

ওই তিন সাংবাদিক জানান, রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এএফএম আঞ্জুমান আরা তাদের ওই সময় জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে তাদের কিছুই জানানো হয়নি। সেখানে ফরম পূরণের আরও দুই দিন পর নেয়া হয় নমুনা।

নমুনা সংগ্রহ নিয়ে এমন ভোগান্তির কারণ জানতে চাইলে কাউন্সিলর আবদুস সোবহান বলেন, তিনি রাসিকের স্বাস্থ্য দপ্তরকে তথ্য দিয়েছিলেন। পরে স্বাস্থ্য দপ্তর নমুনা সংগ্রহ করে রামেক হাসপাতাল ল্যাবে পাঠায়।

কথা ছিল রাসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এএফএম আঞ্জুমান আরাকে ফোন কল কিংবা ক্ষুদে বার্তা পাঠালেই বাড়িতে পৌঁছে যাবে রাসিকের নমুনা সংগ্রহকারী দল। কিন্তু দিনভর চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মুঠোফোর সংযোগ পাচ্ছেন না করোনা আক্রান্তরা।

সোমবার বহুবার চেষ্টা করেও তার মুঠোফোনে সংযোগ মেলেনি। বন্ধ পাওয়া গেছে তার দাপ্তরের ফোনও। ফলে অভিযোগ বিষয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এএফএম আঞ্জুমান আরার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ডা. এএফএম আঞ্জুমান আরার বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক।

তিনি বলেন, নগরীতে করোনায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার পুরো দায়িত্ব রাসিকের।সিভিল সার্জন দপ্তর কেবল সমন্বয় করবে। এই সহযোগিতাটুকুও মিলছে না। এ নিয়ে তিনিও হতাশ।

প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার এমন কাণ্ডে বিব্রত রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং তার দপ্তরের সহযোগিতা না পেয়ে বহু মানুষ অভিযোগ করছেন। এমন কাজে তাদের অভিজ্ঞতারও ঘাটতি রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে তিনিও বিব্রত। ঘটনা তিনি মেয়রকে জানাবেন। এসময় নগরীতে করোনা মোকাবেলায় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে অপরাগতা প্রকাশ করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।

কয়েক দফা চেষ্টায় রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে মেয়রের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রাসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেন, রাসিকের স্বাস্থ্য দপ্তর করোনা আক্রান্তদের একেবারেই খোঁজখবর রাখছে না এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না।

আমরা তাদের খোঁজখবর রাখছি। করোনার চিকিৎসা দেয়া রাসিকের কাজ না, চিকিৎসা দেবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। রাসিক কেবল নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠাচ্ছে। প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করছে।স্বাস্থ্য দপ্তরের নেতৃত্বে এখনও এই কাজটি করছে রাসিক। তবে এ কাজে তাদের সক্ষমতা কম। তারপরও সাধ্যমতো কাজ করছে রাসিক।

তিনি যোগ করেন, নগরীতে করোনা মোকাবেলায় যথাযথ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে রাসিক।ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতি ওয়ার্ডে আলাদা কমিটি কাজ করছে। আগে কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ হয়েছে। এখন ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রতিরোধ কাজ চলছে।

এদিকে, পরিস্থিতি যা-ই হোক এ দুর্যোগে আক্রান্তদের পাশে থাকার অঙ্গিকার পুর্নব্যক্ত করেছেন নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস।

তিনি বলেন, করোনা শনাক্তের খবর পাওয়ার পর থেকেই সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে নগর পুলিশ। বাসার বাজারসহ যখন যা প্রয়োজন পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ সদস্যরা।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/এমআরএম