মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাব
*** স্ত্রীর পর এবার করোনামুক্ত হলেন আলোচিত কাউন্সিলর খোরশেদ
*** করোনার সঙ্গে ১৫ দিন লড়াই করে সুস্থ হলেন এই করোনাযোদ্ধা
*** সুস্থ হয়ে বললেন- যতদিন করোনা থাকবে ততদিন মাঠে থাকব
*** আমি না থাকলেও আমার টিমের সদস্যরা শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে
*** করোনার ভয়ে পিছপা হব না, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যাব
অবশেষে করোনা জয় করলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আলোচিত কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। দীর্ঘ ১৫ দিন পর করোনামুক্ত হলেন এই করোনাযোদ্ধা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খোরশেদ। পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল ছেড়ে নিজ বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি বাসায় বসে করোনাযুদ্ধে গঠিত টিম দিয়ে মানবসেবা করে গেছেন। মরদেহ দাফন থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবা দিচ্ছেন করোনাবীর খোরশেদ। তার পাশাপাশি তার নির্বাচনী এলাকার জনগণের জন্য ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য বিক্রিসহ বিনামূল্যে সবজি বিতরণ করছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়েও থেমে যাননি কাউন্সিলর খোরশেদ।
৮ জুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ‘টিম খোরশেদ’ গঠনের তিন মাস পূর্ণ হয়। তবে উপসর্গসহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন ও সৎকার কার্যক্রমের দুই মাস পূর্ণ করল টিম খোরশেদ।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ‘টিম খোরশেদ’র সদস্যরা
১৩ জুন রাত ৩টায় হঠাৎ একটি কল আসে কাউন্সিলর খোরশেদের মোবাইলে। ফোন রিসিভ করার পর অপরপ্রান্ত থেকে জানানো হয় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লাশের গোসল ও দাফন-কাফনের কোনো লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাই লাশ দাফনে (টিম খোরশেদ ১৩) সহযোগিতা চায় মৃতের পরিবার। তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওই দিন গভীর রাতে লাশ দাফনের জন্য নিজেই বেরিয়ে পড়েন করোনা আক্রান্ত কাউন্সিলর খোরশেদ। এ নিয়ে ৮০তম মরদেহ দাফন সম্পন্ন করেছে টিম খোরশেদ।
এরই মধ্যে রোববার (১৪ জুন) দুপুরে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে করোনামুক্ত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন কাউন্সিলর খোরশেদ। তিনি বলেন, আল্লাহর রহমতে করোনামুক্ত হলাম।
এর আগে কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের স্ত্রী আফরোজা খন্দকার লুনা করোনাভাইরাসমুক্ত হন। বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন। স্বামী-স্ত্রী করোনামুক্ত হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
করোনামুক্ত হয়ে কাউন্সিলর খোরশেদ জাগাে নিউজকে বলেন, আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। মানুষের সেবা করতে গিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জবাসী আমাদের যতটুকু ভালোবাসা দিয়েছেন, আমার শরীরের চামড়া কেটে দিলেও তা শোধ হবে না। বিশেষ করে আমার নির্বাচনী এলাকাবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা সবসময় আমার খোঁজখবর নিয়েছেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের সেবা করে যাব। একই সঙ্গে যত দিন করোনা থাকবে তত দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাব। করোনার ভয়ে পিছপা হব না, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে লড়ে যাব।
করোনায় মারা যাওয়া আরেকজনের মুখাগ্নি করছেন খোরশেদ
তিনি বলেন, আমার স্ত্রী লুনা দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন তারও করোনা নেগেটিভ। এর আগে প্রথমবার করোনা নেগেটিভ এলে ৬ জুন স্কয়ার হাসপাতাল থেকে লুনাকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। পরে লুনাকে বাসায় নিয়ে আসি। সেই সঙ্গে তাকে তাদের বাসায় রাখি। আমি প্রথমবারের মতো করোনা নেগেটিভ হওয়ার খবর পেয়ে স্ত্রীকে আমার বাসায় নিয়ে আসার জন্য ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছি। এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বাসায় থাকব। সেই সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের মানুষের সেবা করে যাব।
করোনাযোদ্ধা খোরশেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু থেকেই বেশি। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে স্বজনদের লাশ ফেলে যাওয়ায় আমরা দাফন-কাফনের দায়িত্ব নিই। একই সঙ্গে লাশ দাফন ও সৎকারের জন্য একটি টিম গঠন করেছি। টিম সদস্যদের নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের ধর্মীয় রীতি মেনে দাফন-কাফন ও সৎকার করা হয়। আমি না থাকলেও টিমের সদস্যরা কাজ চালিয়ে যাবেন।
করোনাযুদ্ধে গঠিত টিম খোরশেদ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রথমবারের মতো গত ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জে দুজন করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত হওয়ার দিন থেকেই টিম খোরশেদ প্রত্যক্ষভাবে করোনা প্রতিরোধে কাজ শুরু করে। ওই সময় মহানগরীতে ২০ হাজার লিফলেট ও মাস্ক বিতরণ এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। টিম লিডার খোরশেদ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জুমার নামাজে বক্তব্য দেন।
১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় একজনের মৃত্যু হয়। ফলে সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও করোনাভীতি ছড়িয়ে পড়ে। বাজারে স্যানিটাইজারের চাহিদা বাড়ায় একদিনেই সঙ্কট সৃষ্টি হয়। টিম খোরশেদ ১৯ মার্চ থেকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফর্মুলা অনুযায়ী স্যানিটাইজার বানানো শুরু করে। ৫০ এমএলের ৬০ হাজার বোতল স্যানিটাইজার ও ১০ হাজার বোতল ২৫০ এলএলের লিকুইড হ্যান্ডওয়াশ সোপ তৈরি ও বিতরণ করা হয়। এ সময় প্রায় ৮০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি টিম খোরশেদের কাছ থেকে ফর্মুলা নিয়ে পুরো জেলায় কমপক্ষে তিন লাখ স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরণ করে।
করোনামুক্ত হওয়া স্ত্রীর সঙ্গে আলোচিত কাউন্সিলর খোরশেদ
কাউন্সিলর খোরশেদ করোনা ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের গোসল, জানাজা, দাফন ও সৎকার করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে জেলা প্রশাসক, সিটি মেয়র ও সিভিল সার্জনের কাছে আবেদন করেন। তাদের অনুমোদনের পর কাজ শুরু করেন তিনি। গত ৮ এপ্রিল প্রথম করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া আফতাব উদ্দিনের দাফনের মাধ্যমে শুরু হয় কার্যক্রম। এ পর্যন্ত ৮০ জনকে দাফন ও সৎকার করেছে টিম খোরশেদ। এর মধ্যে ৩২ জন করোনা আক্রান্ত, ২৪ জন করোনার উপসর্গ ও আটজন স্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফন ও সৎকার করা হয়।
কাউন্সিলর খোরশেদের কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাকে ‘বীর বাহাদুর’ হিসেবে ঘোষণা করেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান। আর খোরশেদের কার্যক্রম দেখে তিনি ২০ লাখ টাকা ভালোবাসার উপহার পাঠান। কিন্তু খোরশেদ এমপি সেলিম ওসমানের ভালোবাসা নিয়ে কাজ করতে চান উল্লেখ করে উপহারের ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেননি।
করোনাকালে মানবসেবায় বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য কাউন্সিলর খোরশেদ দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে গত ৩০ মে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে খোরশেদের। এতে তার টিমের সদস্যরা ভেঙে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় কাউন্সিলর খোরশেদ ঘোষণা দিলেন- মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করোনা নিয়ে যুদ্ধ করে যাব- ইনশাআল্লাহ। যত বাধাই আসুক না কেন দলবলে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের করোনা প্রতিরোধে কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
শাহাদাত হোসেন/এএম/এমকেএইচ