প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে ঘুমাচ্ছেন শেরপুরের সেই ভিক্ষুক
করোনা দুর্যোগে অসহায়দের জন্য সরকারের নেয়া বিভিন্ন খাদ্য কর্মসূচি ও ত্রাণ কার্যক্রমে যখন বিত্তবানদের দুর্নীতির খবরে সবাই হতাশ, তখন মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শেরপুরের এক ভিক্ষুক। করোনার এ সময়ে তিনিই এখন সত্যিকারের হিরো। তার এই মহানুভবতার খবর দেশ পেরিয়ে পুরো বিশ্বকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছে। ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের এ উদারতায় খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে ১২ শতক জমি ও পাকা বাড়ি দিয়েছেন। সেই বাড়ির নির্মাণকাজ এখন শেষ দিকে।
বলছি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধিগাঁও গ্রামের ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনের কথা। করোনার এ ক্রান্তিলগ্নে অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের জন্য যিনি নিজের জমানো ১০ হাজার টাকা দান করেছিলেন ত্রাণ তহবিলে।
গত ২১ এপ্রিল কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ত্রাণ তহবিলে নিজের ভাঙা বসতঘর মেরামত করার জন্য ভিক্ষা করে দুই বছরে সঞ্চয়ের ১০ হাজার টাকা দান করেন ওই ভিক্ষুক।
এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হলে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নাজিম উদ্দিনকে দেয়া হচ্ছে ১২ শতক জমি এবং পাকা বাড়ি। এছাড়া জীবিকা নির্বাহের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে একটি মুদি দোকান।
ওই সময় নাজিম উদ্দিনের এমন উদারতায় মুগ্ধ হন চিত্রনায়ক ওমর সানি। তিনি নাজিম উদ্দিনকে বাবা ডেকে পায়ে সালাম করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন ১৯৪০ সালের ৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিনটি বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম ময়না খাতুন। সেই ঘরে মমেন আলী নামে তার এক ছেলে রয়েছে। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হালেমা বেগম। ওই ঘরে নজেদা খাতুন নামে এক কন্যাসন্তান আছে তার। এ মেয়েটি মানসিক রোগী। ওই দুই স্ত্রীর সাথে অনেক আগেই তার ছাড়াছাড়ি হয়েছে। বর্তমান স্ত্রীর নাম আবেদা খাতুন। আবেদা বিকলাঙ্গ ও মানসিক রোগী।
এ ঘরে আসকর আলী, সুন্দরী, তানজিলা ও আব্দুল্লাহ নামে চার সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে ছেলে আসকর আলী বিয়ে করে আলাদা থাকে। মেয়ে সুন্দরীর বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে।
টানাপোড়েনের সংসারে জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করেন নাজিম উদ্দিন। একসময় গারো পাহাড়ে লাকড়ি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন তিনি। এরপর কোদালের জন্য কাঠ (আঁছারি) বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতেন।
নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘গারো পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড়ের ড্রেনে পুইড়ে গেয়ে (পড়ে গিয়ে) পা ভাঙল, কাম-কাজ করবার পাই না। মানুষ কামলাও নেয় না। পরের থেইক্যা ভিক্ষা কইরে খাওয়া শুরু করলাম।’
করোনায় কর্মহীনদের জন্য তার অনুদান সম্পর্কে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভিক্ষা করতে করতে খাইয়ে-খুইয়ে ১০ হাজার টেহা ডাইনে (আয়) হইল। টেহাডি ঘর-দরজা ঠিক করবার জন্যে থুইছিলাম (রাখা হয়েছিল)। কিন্তু এহন দেশে আইলো করোনা, শুরু হইল দশের অভাব। ভাবলাম বয়স হইয়া গেছে মইরাই যামুগা। এই ট্যাহাগুলান যদি মাইনসের কাজে লাগে, এই চিন্তার থ্যাইক্কা দশের জন্যে টেহাগুইলে ইউএনওরে দিছি।’
একই এলাকার সাত্তার মিয়া বলেন, উদার মনের মানুষ নাজিম উদ্দিন। আগেও পাড়ার জুম্মাঘরে (মসজিদে) মাঝে মধ্যেই একশ, দুশ টাকা দান করতেন। এলাকার মানুষের সব কামে (কাজে) সাহায্য করেন তিনি। সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক তার। ওযে এই দান করলো, আল্লাহ ওরে ভালা করুক।
একই এলাকার মুদি দোকানি জহির মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ১ট্যাহা পয়সা (টাকা-পয়সা) মাইনষের থাকলেও মানুষ কারোরে দেয় না, তয় আমগো গেরামের নাজিম চাচা মাইনষের (মানুষের) খাওনের লাইগা তার জমানি ট্যাহা দান করছে। এইডা কয়জনের সাহসে কুলায়!’
দারিদ্র্যতার কারণে নিজের সন্তানরাও ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনকে ভালোভাবে দেখভাল করতে পারতেন না। একটি থাকার ঘর, তবুও ভাঙাচোরা। সেটা মেরামতের জন্যই দুই বছরে জমিয়ে ছিলেন ১০ হাজার টাকা। মহামারি করোনায় কর্মহীনদের জন্য এই টাকাও দান করেছেন তিনি। ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে তিনি বলেন, হেরাও কষ্টে থাহে। সংসার নিয়াই ব্যস্ত থাহে। প্রধানমন্ত্রীর উপহার সামগ্রী পাওয়ার পর তারা (ছেলে-মেয়েরা) দেখা করতে এসেছিলো বলে জানান তিনি।
এখনও পুরোপুরি নির্মাণকাজ শেষ না হলেও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া পাকা ঘরে বিছানা পেতেছেন নাজিম উদ্দিন। বর্তমানে সেই ঘরেই থাকছেন তিনি। একই ঘরের সঙ্গে দোকানের নির্মাণকাজ শেষ হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে বাড়িটি।
অসহায় মানুষের জন্য্য ১০ হাজার টাকা দান করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জীবন পাল্টে গেছে জানিয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি তো খুশির উপরে খুশি। হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) যহন জিনিসটে আমারে দিছে, আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন হাসিনারে সুহে (সুখে) রাহে, হায়াত বাড়াই দেয়।’
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, নাজিম চাচার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি পাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। ঘরের কাজ শেষের দিকে। এছাড়া আগে থেকেই উনার বয়স্ক ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড ছিল। উপজেলা প্রশাসন থেকে তার পরিবারের খাবারের জন্য নিয়মিত ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এবিএম এহছানুল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিনকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি দোকান করে দেয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই দোকানের কাজ শুরু হবে। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তথ্য ও ভিডিও : ইমরান হাসান রাব্বী/এমএএস/পিআর