তিন শতাধিক নমুনা সংগ্রহ করে আক্রান্ত চিকিৎসাকর্মীর ঘরে তালা
কি রাত, কি দিন। অসুখ-বিসুখে এলাকার লোকজন যখনই ডাকেন ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তখই হাজির হন সুশান্ত কুমার দাস। পেশায় ল্যাব টেকনিশিয়ান সুশান্তকে তাই সবাই ডাকেন সুশান্ত ডাক্তার নামেই। ৩০ বছর ধরে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি। ২০১৬ সাল থেকে গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত সুশান্ত। বোয়ালিয়া বাজারে বাড়ির পাশেই বোয়ালিয়া ফার্মেসি নামে তার প্রাইভেট চেম্বার। করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহে নামার পর চেম্বারে বসেন না সুশান্ত।
চলমান করোনা যুদ্ধেও লড়ে যাচ্ছিলেন সামনে থেকে। সীমিত সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন করোনাযুদ্ধে। এরই মধ্যে উপজেলার তিন শতাধিক মানুষের নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। উপজেলায় ছয়জনের করোনা শনাক্তের পর সপ্তম ব্যক্তি হিসেবে আক্রান্তের তালিকায় উঠে এসেছে তার নাম।
প্রথমে সহকর্মীর করোনাভাইরাস শনাক্তের পরে নমুনা দেন সুশান্ত। আর তাতেই তার করোনা ধরা পড়ে। ৩ জুন খবর আসে তিনি করোনায় আক্রান্ত। এরপর থেকে বদলাতে শুরু করে দৃশ্যপট।
খবর জানাজানি হওয়ার পর ৪ জুন রাতে তার বাসার দুই দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয় বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ। শনিবার (৬ জুন) বিকেলে গিয়ে নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় সুশান্ত কুমার দাসকে।
করোনায় আক্রান্ত হলেও এখনও তার উপসর্গ প্রকাশ পায়নি। নিজ বাড়িতে তিনি আইসোলেশনে আছেন। তারপরও তালাবদ্ধ করে রাখায় বৃদ্ধ বাবা, স্ত্রী ও নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েসহ কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি।
তালাবদ্ধ দরজার ওপার থেকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সুশান্তের। চোখেমুখে কষ্টের ছাপ তার। এ অবস্থায় তিনি বলেন, আমার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপও আছে। করোনা সংক্রমণ আমাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি অবরুদ্ধ হয়ে।
‘এটি আমার জন্য মানসিক নির্যাতন। চিকিৎসাকর্মী হিসেবে এটি প্রত্যাশা করিনি। বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। কিন্তু এখনও আমার খোঁজ নেয়নি কেউ। আসেননি উপজেলা প্রশাসনের কেউ’ বলছিলেন সুশান্ত।
তিনি আরও বলেন, অবরুদ্ধ করে রাখার পর ইউনিয়ন পরিষদ ইচ্ছা হলে খোঁজ নিচ্ছে, না হলে নিচ্ছে না। দরকার হলে সহায়তা নিচ্ছি প্রতিবেশীদের। চারপাশে আমাকে নিয়ে চলছে নানা কানাঘুষা। এখন আমার বোয়ালিয়া ফার্মেসিটি চিরতরে বন্ধের পাঁয়তারা চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুশান্তের বাড়ির দরজার পাশেই ঝোলানো লাল নিশান। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সুশান্তের বৃদ্ধ বাবা। বাইরের পৃথিবী দেখছিলেন সেখান থেকে। এই আঘাত তাকেও স্পর্শ করেছে। চরম মানসিক আঘাত পেয়েছেন তার স্ত্রী-কন্যাও।
তাদেরকে তালাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শুকুরুদ্দিন। তিনি বলেন, করোনা শনাক্তের পরও রাত-বিরাতে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন ওই ব্যক্তি। এ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। তাদের চাপে বাধ্য হয়ে তার বাড়ির দরজায় তালা ঝোলানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে জানিয়ে তালা দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে কয়েক দফা চেষ্টা করেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের মোবাইল ফোনের সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে তার মন্তব্য মেলেনি।
তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সারোয়ার জাহান সুমন বলেন, বিষয়টি শুনেছি। একজন চিকিৎসাকর্মীর সঙ্গে এমন আচরণ চরমভাবে ব্যথিত করেছে। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও জানিয়েছি আমি।
তবে এই চিকিৎসাকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখার বিয়ষটি অনেকটাই সমর্থন করলেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি শুনেছি করোনা শনাক্তের পরও সুশান্ত কুমার দাস ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখছেন। এই কারণে তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
তবে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ শুরুর পর থেকে চেম্বারে কোনো রোগী দেখেননি বলে জানিয়েছেন সুশান্ত কুমার দাস।
চিকিৎসাকর্মীকে তালাবদ্ধ করে রাখার খবরে অবাক চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হক। তিনি বলেন, এমনটি হয়ে থাকলে সত্যিই অমানবিক। এমন খবর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে জানাননি। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।
এএম/জেআইএম