ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

জীবিত ছেলেকে তো আর দেখা হবে না, কবর দেখেই সান্ত্বনা নেব

জেলা প্রতিনিধি | যশোর | প্রকাশিত: ০৮:১৩ পিএম, ৩০ মে ২০২০

লিবিয়ায় নিহত রাকিবুলের মা মাহেরুন নেছা’র বুকফাটা আহাজারিতে কাঁদছে গোটা খাটবাড়িয়া গ্রাম।সন্তান হারানো মায়ের আর্তি ‘আমাগের আর ছাদের বাড়ি করা লাগবে না। সংসারের সুখ লাগবে না। তুই ফিরে আয় বাজান, ফিরে আয়! আপনেরা আমার সোনারে আমার কাছে আনি দেন! আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছেন মাহেরুন নেছা।

সাড়ে তিনমাস আগে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামের ইসরাইল হোসেনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম রাকিব (২০) লিবিয়ায় যান। একটু স্বচ্ছল জীবনযাপনের জন্যে উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন তিনি। সম্পত্তি বিক্রি আর জমানো টাকা খরচ করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন ইসরাইল হোসেন।

ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পাশাপাশি পরিবারের স্বচ্ছলতার কথা ভেবেই লেখাপড়ার পাট শেষ না করেই তাকে বিদেশ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, সন্তান আর সম্পত্তি হারিয়ে বাকরুদ্ধ রাকিবুলের বাবা ইসরাইল ও মা মাহেরুন নেছা।

পরিবারের অভিযোগ, দালালের মাধ্যমে রাকিবুলকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। দালাল চক্র লিবিয়ার একটি শহরে ছেলে রাকিবকে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুঠোফোনে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরিবারের লোকজন টাকা দিতে রাজিও হন। কিন্তু এরই মধ্যে খবর এলো দালাল চক্র রাকিবুলকে গুলি করে হত্যা করেছে।

jagonews24

গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে বৃহস্পতিবার ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে পাচারকারী চক্র। এদেরই একজন যশোরের ঝিকরগাছার সন্তান রাকিবুল।

শনিবার ঝিকরগাছা উপজেলার খাটবাড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ বাবা ইসরাইল হোসেন চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। আর মা মাহেরুর নেছা আহাজারি করে চলেছেন। ছেলেকে দেখার আকাঙ্খায় তাদের আহাজারি যেন কিছুতেই থামছে না। এলাকার শত শত নারী পুরুষ ছুটে আসছেন তাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। চার ভাই-বোনের মধ্যে রাকিবুল সবার ছোট। যে কারণে তার মৃত্যুর খবরে মা-বাবা, ভাই-বোন মুষড়ে পড়েছেন।

রাকিবুলের বড় ভাই সোহেল রানা বলেন, পরিবারে স্বচ্ছলতা ও উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছিল রাকিবুল। ভালো কাজের জন্য দালালের মাধ্যমে তাকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু শুরু থেকেই দালালেরা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে। পরে তাকে আটকে রেখে ১৭ মে ফোনে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ওই টাকা দুবাই থেকে তারা নিতে চায়। ভাইয়ের মুক্তির জন্য ওই টাকা দিতে রাজিও হয়েছিলেন তারা।

আগামী ১ জুন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলেন না। তার চাচাতো ভাই সকালে লিবিয়া থেকে ফোন করে জানিয়েছেন, যে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে রাকিবুলও রয়েছে।

jagonews24

সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

রাকিবুলের বাবা ইসরাইল হোসেন জানান, রাকিবুল যশোর সরকারি সিটি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। রাকিবুলের চাচাতো ভাই ফিরোজ হোসেন লিবিয়া প্রবাসী। ওই ভাই লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশি দালাল আব্দুল্লাহ’র সঙ্গে যোগাযোগ করে রাকিবুলকে লিবিয়ায় নিয়ে যান। সাড়ে তিন মাস আগে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে রাকিবুলকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছিলো। চাচাতো ভাই ফিরোজ হোসেনের মাধ্যমে লিবিয়ার দালাল আব্দুল্লাহর সহযোগিতায় প্রথমে ভারত থেকে দুবাই, এরপর মিশর হয়ে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে পৌঁছায় রাকিবুল। সেখান থেকে লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে জিম্মি হওয়ার পর মানব পাচারকারীদদের গুলিতে রাকিব নিহত হয়।

ইসরাইল হোসেন আরও বলেন, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, ভিটে-বাড়ি বিক্রি করে রাকিবের মুক্তিপণের টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চলছিল। আগামী ১ জুন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে পাচারকারীরা তাদের সবকিছু শেষ করে দিলো। এখন সরকারের কাছে তাদের আবেদন, ‘সন্তানের লাশ বাড়ি আনতে চাই।’

jagonews24

আহাজারি করতে করতে রাকিবুলের মা মাহেরুন নেছা জানান, মুক্তিপণের জন্য প্রায়ই রাকিবুলের ওপর নির্যাতন চালাতো তারা। তাকে বাঁচাতে তারা মুক্তিপণের টাকাও জোগাড় করছিলেন। এখন তিনি ছেলে হত্যার বিচার চান।

মাহেরুন নেছা বললেন, জীবিত ছেলেকে তো আর দেখতে পাবো না! ছেলের লাশ এনে কবর দিতে চাই। ছেলের কবর দেখেই সান্ত্বনা নেবো।

যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম জানান, নিহত রাকিবের মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।

মিলন রহমান/এমএএস/এমকেএইচ