ভয়-আতঙ্ক হয়, তারচেয়ে বেশি হয় গর্ব
গোটা বিশ্বে লাশের সারি ফেলে দিয়েছে মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। এই ভাইরাস আক্রান্ত করেছে লাখ লাখ মানুষকে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে তাই মানুষকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা-বাড়ি থেকে বের হতেও নিষেধ করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ছোঁয়াচে এ ভাইরাস যে কোনো সময় যে কারও শরীরে বাসা বাঁধতে পারে বলে এক অজানা ভয়-আতঙ্কে দিন কাটছে বিশ্ববাসীর।
অথচ এই ভয়-আতঙ্কের বিপরীতে বুক চিতিয়ে লড়াই করছেন একদল। এরা হলেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। ঝুঁকি নিশ্চিত জেনেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে সুস্থ করার মহান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা। স্ত্রী বা স্বামী-সন্তানকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সার্বক্ষণিক রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকছেন।
এসব চিকিৎসকের পরিবারের দিন কাটে কীভাবে? স্বজনকে এভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে দেখে কী কাজ করে তাদের মনে? এ নিয়ে কয়েকজন চিকিৎসক-নার্সের স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছে জাগোনিউজ। জানা যায়, তারা প্রিয়জনকে নিয়ে চাপা আতঙ্ক আর ভয়ে থাকেন ঠিক, তবে তার চেয়েও বেশি হয় গর্ব। বুকভরা এ গর্ব হয় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আনন্দে।
খুলনার নুরনগরে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১ থেকে ১০ এপ্রিল টানা ১০দিন মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন নিউরোমেডিসিন বিভাগের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. বাপী রায়। চিকিৎসা দিয়ে এখন তিনি কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তার দায়িত্বপালনকালে ওই হাসপাতালে সর্বোচ্চ রোগী ছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যুও হয় সেখানে।
বাপীর বাবা খুলনা জর্জ কোর্টের আইনজীবী অধ্যাপক নিমাই চন্দ্র রায় বলছিলেন, ‘ছেলেকে চিকিৎসক বানিয়েছিলাম যাতে মানুষের সেবা করতে পারে। তাই দেশের প্রয়োজনে সত্যিকারের যোদ্ধা হিসাবে ছেলে যখন করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে যাবে শুনেছি, তখন কিছুটা আতঙ্ক কাজ করলেও পরক্ষণে গর্বে বুক ফুলে উঠেছে।’
বাপীর মা বটিয়াঘাটা উপজেলার ঝড়ঙাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা করুনা রায়। সন্তানের জন্য আশীর্বাদপ্রার্থী এ মা বলছিলেন, ‘আমার ছেলের জন্য সারাদিন ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, সে যেন নিজে সুস্থ থেকে সবাইকে সেবা করে সুস্থ করে তুলতে পারে।
করোনা ডেডিকেটেড ওই হাপাতালে চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন অভিজিৎ কুমার মৃধা। তিনি খুমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ইনডোর মেডিকেল অফিসার। তার মা ননীবালা মৃধা সাতক্ষীরার শ্যামনগরের প্রত্যন্ত এলাকায় বসে তার জন্য দিনরাত প্রার্থনা করছেন সন্তানের জন্য।
করোনাজয়ী নার্স শিলা রানী দাস
ননীবালা বলেন, ওর ছোটবেলায় ভাবতাম যে আমার ছেলে একদিন বড় হয়ে চিকিৎসক হয়ে সকলের সেবা করবে। ইশ্বর আমার কথা শুনেছেন। আশা করি এই যুদ্ধে আমার ছেলেসহ সকল চিকিৎসকেরই জয় হবে।
রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক অভিজিৎ শিকদারও দায়িত্বপালন করেছেন নুরনগর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে। তার দায়িত্বপালনের সময় তিনজন চিকিৎসকসহ অনেক রোগী সেখানে ছিল। একজনের মৃত্যুও হয়েছে। অভিজিৎ শিকদারের বাসা খুলনার বানরগাতিতে। খুব কাছাকাছি থাকার পরও প্রায় এক মাসের মতো নিজের ছেলেকে দেখেন না অভিজিৎ এর বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নিখিল শিকদার। টানা ১০ দিন করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে এখন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে সিএসএস আভা সেন্টারে রয়েছেন চিকিৎসক অভিজিৎ।
নিখিল শিকদার বলেন, আমার ছেলেকে নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। কষ্ট নেই। শুধু গর্ব আছে। পৃথিবীর সকল মানুষ যখন গৃহবন্দী, তখন যে চিকিৎসকরা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করছে, দিনরাত পরিশ্রম করছে, তাদের জন্য সম্মান জানানোর ভাষা নেই। তবে আমার ছেলে করোনা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয় বলে অনেক সময় এলাকায় আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মনে হয় আমরাও করোনা আক্রান্ত। এটা বন্ধ করা উচিত।
খুলনা মেডিকেল কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের খুলনা বিভাগীয় সভানেত্রী শিলা রানী দাস করোনা হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই গত ২৮ এপ্রিল আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তবে এখন তিনি সুস্থ। আবারও ফিরতে চান রোগীদের সেবায়।
তার মেয়ে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রিংকি রানী দাস বলেন, আমার মাকে ছোট থেকে দেখেছি নার্স হিসাবে সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে। তখন থেকে নিজেও চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আমার মা যখন করোনা আক্রান্ত হন, তখন খুবই ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু সাহস হারাইনি। এই করোনাযুদ্ধে আমার মাকে নিয়ে আমি ও আমার পরিবার গর্বিত।
আলমগীর হান্নান/এইচএ/এমএস