৩০৬ নামের পাশে তিনজনের নম্বর, চেয়ারম্যান বললেন কম্পিউটারে সমস্যা
হবিগঞ্জে করোনাভাইরাসের প্রভাবে কর্মহীন মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ উপহার হিসেবে দেয়া দুই হাজার ৫০০ টাকার প্রণোদনার তালিকা তৈরিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে।
৫০ লাখ হতদরিদ্র ও কর্মহীন পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। গত বৃহস্পতিবার (১৪ মে) এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে সরাসরি নগদ অর্থ প্রেরণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের হিসাবে সরাসরি নগদ অর্থ পাঠাবেন প্রধানমন্ত্রী।
এই প্রণোদনার তালিকায় ১৬২ জনের নামের পাশে লাখাই উপজেলার এক ইউপি চেয়ারম্যানের চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৯৯ জনের নামের বিপরীতে চেয়ারম্যানের এক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের আরেক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর ৪৫ জনের নামের পাশে দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে ৩০৬ দরিদ্রকে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার চেয়ারম্যানের ঘরে। এমন তালিকা তৈরি করেছেন মুড়িয়াউক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাই।
পাশাপাশি অনেক স্থানে একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির নাম দেয়া হয়েছে তালিকায়। অনেক সম্পদশালীর নামও তালিকায় রয়েছে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আত্মীয়-স্বজন কারও নামই তালিকা থেকে তেমন বাদ পড়েনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যানও।
লাখাই উপজেলার চেয়ারম্যান মো. মুশফিউল আলম আজাদ বলেন, উপজেলার ছয় ইউনিয়নেই প্রণোদনার তালিকায় ঘাপলা রয়েছে। চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের নাম এবং মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। অনেকেই ভুয়া নাম দিয়ে নিজেদের আত্মীয়দের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। শুরুতেই তাদের দেয়া তালিকায় গলদ ধরা পড়েছে। ফলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে। আরও পরে ধরা পড়লে চেয়ারম্যান পদ হারাতে হতো। ভাগ্য ভালো যে, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিল ইউপি চেয়ারম্যানদের তালিকা যেন যাচাই-বাছাই করা হয়। এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা যাচাই-বাছাই করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রণোদনার টাকা পাওয়ার তালিকায় মুড়িয়াউক ইউনিয়নের এক হাজার ১৭৬ জনের নাম রয়েছে। এই তালিকা দিয়েছেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাই। তালিকায় নিজের আত্মীয় আনোয়ারের মোবাইল (০১৯৪৪৬০৫১৯৩) নম্বর ব্যবহার করেছেন ৯৯ জনের নামের পাশে। চাচাতো ভাই আক্তার মিয়ার মোবাইল (০১৭৪৪১৪৯২৩৪) নম্বর ৯৭ জনের এবং চাচা শাকিল হকের মোবাইল (০১৭৮৬৩৭৪৩৯১) নম্বর ৬৫ জনের নামের পাশে ব্যবহার করেছেন চেয়ারম্যান। সেই সঙ্গে চেয়ারম্যানের আরেক নিকটাত্মীয় নবী মিয়ার মোবাইল (০১৭৬৬৩৮০২৮৪) নম্বর ৪৫ জনের নামের পাশে দেয়া হয়েছে। সবমিলে বলা যায়, ৩০৬ দরিদ্রের তালিকা চেয়ারম্যানের ঘরেই রয়েছে।
এছাড়া ১০-১২টি মোবাইল নম্বর একাধিক নামের পাশে ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি নামগুলোর পাশে ৩০-৩৫টি মোবাইল নম্বর একাধিকবার ব্যবহার করে তালিকা শেষ করা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কোনো হিন্দু পরিবারের বসবাস না থাকলেও তালিকার ৯৫৮, ৯৬৫ ও ৯৭৩ সিরিয়ালের তিনটি নাম হিন্দু ব্যক্তির দেয়া হয়েছে। আবার ওই ইউনিয়নের সম্পদশালী আক্কল আলীর ছেলে সাহাব উদ্দিনে নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকার ১৬১ ও ১৬৩ নম্বরে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নাম দেয়া হয়েছে। তালিকার ৯৫১, ৮৫৫, ৮৫৩, ৮৫২, ৮৫১ ও ৭৮৪ নম্বরের ছয়জন একই পরিবারের সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুড়িয়াউক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাই বলেন, আমরা মাত্র ৭৩০ জনের নাম দিয়েছি। এর মধ্যে মেম্বারদের দেয়া নামও আছে। তালিকা তৈরি করতে হয়েছে পিআইও অফিসে গিয়ে। সেখানে কম্পিউটারে এক নম্বর টিপলে আরেক নম্বর উঠে যায়। এজন্য একই নম্বর একাধিক ব্যক্তির নামের পাশে উঠেছে। এছাড়া তালিকা তৈরি করার জন্য আমাদের সময় দেয়া হয়নি। যাদের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়। তারা সবাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজন। ষড়যন্ত্র করে এক নম্বর একাধিক নামের সঙ্গে তুলে দেয়া হয়েছে।
ভাইস চেয়ারম্যানের আত্মীয়দের মোবাইল নম্বর আপনার দেয়া তালিকায় কীভাবে উঠেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটিতো বলতে পারছি না। আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কেউ তুলে দিয়েছে মনে হয়।
জানতে চাইলে লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসি কান্ত হাজং বলেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। এখানে চেয়ারম্যানরা স্বজনপ্রীতি করেছেন। এসব হতে পারে বলেই আগে থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। বলা হয়েছে চেয়ারম্যানদের তালিকা যেন যাচাই-বাছাই করা হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে তালিকায় ত্রুটি ধরা পড়েছে। এখন যাচাই-বাছাই করার জন্য ট্যাগ অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের মাঠকর্মী, উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা এখন দায়িত্ব পালন করছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা যাচাই-বাছাই করছেন। যারা সহায়তা পাওয়ার যোগ্য কেবল তাদের এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। শনিবারের মধ্যে যাচাই-বাছাইকৃত তালিকা হস্তান্তর করবেন মাঠকর্মীরা।
উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, লাখাই উপজেলার ছয় ইউনিয়নে ছয় হাজার ৭২০ পরিবার নগদ দুই হাজার ৫০০ টাকা করে সরকারি অর্থ সহায়তা পাবেন। এর মধ্যে লাখাই ইউনিয়নে এক হাজার ১৯৪ জন, মোড়াকরি ইউনিয়নে এক হাজার ১১৩, মুড়িয়াউক ইউনিয়নে এক হাজার ১৭৬, বামৈ ইউনিয়নে এক হাজার ২৪৬, করাব ইউনিয়নে এক হাজার ছয়জন ও বুল্লা ইউনিয়নে ৯৮৫ জন।
এর প্রেক্ষিতে প্রতিটি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে খসড়া তালিকা জমা দেন। প্রায় প্রতিটি তালিকায় ঘাপলা ধরা পড়েছে। একটি মোবাইল নম্বর একাধিক ব্যক্তির নামের পাশে, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি এবং অধিক সচ্ছল পরিবারও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এমন ঘাপলা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসেছে উপজেলা প্রশাসন। সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাই শুরু হয়েছে।
এএম/জেআইএম