ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

অযত্নেই বাড়ছে রাজশাহীর আম

ফেরদৌস সিদ্দিকী | রাজশাহী | প্রকাশিত: ০৯:৩৪ পিএম, ১০ মে ২০২০

সুস্বাদু আম বলতেই সবার আগে মনে আসে রাজশাহীর নাম। বৃহত্তর রাজশাহীর এই আমের খ্যাতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়েছে বহু আগেই। দিনে দিনে আম হয়ে উঠেছে কৃষি প্রধান এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতি প্রবাহের নিয়ন্ত্রক। প্রতি বছর যে আমে এই অঞ্চলে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয় সেই আম গাছে বাড়ছে অনেকটা অযত্নে। এর কারণ একটাই বৈশ্বিক মহামারি করোনা।

জেলা প্রসাশনের বেঁধে দেয়া সময়সূচি অনুযায়ী, আগামী ১৫ মে থেকে একে একে বাজারে উঠবে ফলের রাজা আম। স্থানীয় আম চাষিরা বলছেন, অন্য বছর এই সময় আম বাগান কয়েকবার হাত বদল হয়ে যায়। কিন্তু করোনার প্রভাবে এখনও অধিকাংশ আম বাগান পড়েই আছে। পরিবহন ও বাজারজাত শঙ্কায় ফিকে হতে বসেছে এই অঞ্চলের হাজারো আম চাষি ও বাগান মালিকের স্বপ্ন।

তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের টানা লোকসানে অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন। এরপরও এবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিলেন চাষিরা। তবে করোনায় সে আশায় গুড়েবালি। ফলে বাগান পরিচর্যায় বাড়তি অর্থলগ্নি করতে চাইছেন না মালিকরা। এতে অনেকটাই অযত্নে বাড়ছে আম।

সাধারণ চাষিদের চেয়েও খারাপ অবস্থা রফতানির উদ্দেশ্যে আম চাষিদের। বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে আম রফতানি নিয়ে শঙ্কায় তারা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ম্যাঙ্গ প্রডিউসার কোঅপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম বলেন, আম রফতানিকারকদের সঙ্গে তাদের ২০ জন আম উৎপাদনকারীর চুক্তি হয়েছে। কিন্তু করোনা সংকটের ফলে এখন রফতানিকারকরা তাদের এড়িয়ে চলছেন। অনেক চেষ্টার পরও তাদের নাগাল পাচ্ছেন না চাষিরা। এই পরিস্থিতিতে আম রফতানি নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকেই বাগান পরিচর্যা বাদ দিয়েছেন বলেও জানান এই আম চাষি।

একই ভাষ্য রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহ্বায়ক আনোয়ারুল হকের। তিনি বলেন, দেশে এখন নিরাপদ রফতানিযোগ্য প্রচুর আম উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। করোনা প্রেক্ষিতে ফলের চাহিদা বাড়ায় তৈরি হয়েছে নতুন বাজার। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগোতে হবে। তবে করোনার কারণে আমের বিশ্ববাজার হারানোর শঙ্কা নেই বলে জানান তিনি।

তবে এই পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই আম বাগান পরিচর্যা ছেড়ে দেয়া যাবে না বলে আম চাষি ও বাগান মালিকদের পরামর্শ দিয়েছেন বারির উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরফ উদ্দিন।

তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানি বন্ধ রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ আম বেশি পছন্দ করেন। কাজেই আম রফতানি না করা গেলেও দেশেই বাজারজাত করা যাবে। চাষিদের উচিৎ না ছেড়ে আম যে পর্যন্ত গাছে আছে সেই পর্যন্ত পরিচর্যা করা।

এই আম গবেষক আরো বলেন, আম বাজারে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। করোনা সংক্রমণ এড়াতে আম বাজারগুলোর পরিসর বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে ক্রেতা-বিক্রেতারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কেনাবেচা করতে পারেন। এই ঘোষণা আগে ভাগেই দেয়া জরুরি।

তিনি বলেন, ঢাকা-নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আম কিনতে প্রচুর লোকের সমাগম হয় রাজশাহী অঞ্চলে। ক্রেতাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতে হবে।

আম নিয়ে কোনোভাবেই ভীতি ছড়ানো যাবে না বলে উল্লেখ করে ড. শরফ উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন সময় কেমিকেল মেশানো আম নষ্টের খবর আসে গণমাধ্যমে। এমন খবরে আমে আগ্রহ হারাচ্ছে লোকজন। করোনা পরিস্থিতিতে এমন খবর জনমনে আরও আতঙ্ক ছড়াতে পারে। ফলে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই চাষির আম নষ্ট করা যাবে না।

জানতে চাইলে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বলেন, এখনো তেমন বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। আম পরিমাণে কম থাকলেও বাড়তি রয়েছে ভলো। আশা করা যাচ্ছে এবার ফলনও বেশ ভালোই হবে। কিন্তু সঙ্গত কারণেই আম নিয়ে এবার চাষিরা গভীর উদ্বেগের মধ্যে আছেন। তার আশা কৃষিপণ্য হিসেবে সরকার আমকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে।

ড. আলীম উদ্দিনের মতে, এবার আম নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট হতে পারে পরিবহন এবং বাজারজাতকরণে। এ ক্ষেত্রে রেলওয়েকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আম পরিবহনের জন্য রাজশাহী-ঢাকা বিশেষ ট্রেন চালু করা যেতে পারে। এতে চাষির লোকসান কমবে।

পরিপক্ক আমে পচন রোধে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন ড. আলীম উদ্দিন। তিনি বলেন, চাইলে যে কেউ নিজ বাড়িতেই আমে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আম গাছ থেকে নামানোর পর ৫৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় গরম পানিতে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে আমের জন্য ক্ষতিকর সবধরনের জীবানু মারা পড়বে। এই প্রযুক্তি আমের পচন ও পাকা ঠেকাবে ৫ থেকে ৭ দিন। কুরিয়ারে আম পরিবহনের ক্ষেত্রে এটি বড় প্রাপ্তি।

এদিকে আম বাজার ঘিরে স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখেছে স্বাস্থ্য দফতর। রাজশাহীর বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের পরিচালক ডা. গোপেন্দ্র নাথ আচার্য্য জানান, আম বাজারে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন। তাদের এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বাইরে থেকে আমের মৌসুমে বিপুল সংখ্যক ক্রেতা রাজশাহী অঞ্চলে আসেন। যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে আসবেন তাদের অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। তবে এখনও আম বাজার কেন্দ্রিক মেডিকেল টিম গঠন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তারাও ভাবছেন।

আঞ্চলিক কৃষি দফতরের হিসেবে, রাজশাহী অঞ্চলে এ বছর আম বাগান রয়েছে সবমিলিয়ে ৮০ হাজার ৩৬০ হেক্টর। এ থেকে উৎপাদন হতে পারে ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭৭০ টন আম। গত বছর ৭২ হাজার ৯০৯ হেক্টর আম বাগান থেকে আম উৎপাদন ছিলো ৮ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৮ টন।

সূত্র বলছে, বিভাগে সবচেয়ে বেশি আমবাগান রয়েছে আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এই জেলায় ৩০ হাজার ৩৫ হেক্টর আম বাগান থেকে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৯ হাজার টন আম।

এবার সবেচেয়ে বেশি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে নওগাঁয়। বরেন্দ্রখ্যাত এই জেলায় ২৪ হাজার ৭৭৫ হেক্টর আম বাগান থেকে এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৫৩৯ টন।

এছাড়া রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর বাগানে ২ লাখ ১০ হাজার ৯৪৭ টন এবং নাটোরে ৪ হাজার ৮৬৪ হেক্টরে ৬৭ হাজার ২৮৪ টন আম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী, যথেষ্ট প্রস্তুতি সত্ত্বেও রাজশাহী থেকে আম রফতানি হচ্ছে সামান্যই। গত বছর রাজশাহী জেলা থেকে ৩৬ দশমিক ৪৪৭ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে ৬৪ দশমিক ৪৫ টন আম রফতানি হয়। এবার তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এফএ/এমএস