করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে যদি মরে যাই দুঃখ নেই
বিশ্বকে থমকে দিয়েছে কোভিড-১৯ নামের অদৃশ্য এক ভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী কোনো ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। ফলে ক্রমশ বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা। করোনাভাইরাসে বহু মানুষের প্রাণহানি যেমন শঙ্কা বাড়িয়েছে, তেমনি আশা জাগিয়েছে কিছু মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠার গল্প।
পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হয়তো এই যুদ্ধে তারা সফল হবেন। বিজয়ের বেশে তাদের সঙ্গে করোনামুক্তির আনন্দ উদযাপন করবে বিশ্ববাসী।
ডাক্তার তাসফিয়া আহমেদ-ছবি জাগো নিউজ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমনই দুই করোনাযোদ্ধা ডা. মো. আকিব জাভেদ রাফি এবং ডা. তাসফিয়া আহমেদ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথম ধাপে যে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম লিপিবদ্ধ করা হয় তাদের একজন আকিব জাভেদ রাফি ও আরেকজন তাসফিয়া আহমেদ। তারা দুইজনই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৯তম ব্যাচের স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। ফ্রন্টলাইনের এই যোদ্ধারা তাদের পরিবারের সদস্যদের মায়া ত্যাগ করে রাত-দিন কাজ করছেন দেশের তরে, মানবতার ডাকে।
রাফি ও তাসফিয়া দুইজনই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের মেড্ডা এলাকার বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১১ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১০ দিন তারা আইসোলেশন সেন্টারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়েছেন। রোগীদের সঙ্গে সেখানেই তাদের খাওয়া-ঘুম সবকিছু হয়েছে। টানা দায়িত্ব পালনের পর তাদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই সঙ্গে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে তাদের ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় আগামীকাল সোমবার (১১ মে) থেকে আবারও তারা আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করবেন।
পিপিই পরা চিকিৎসক আকিব জাভেদ রাফি- ছবি জাগো নিউজ।
রাফির বাড়ি কুমিল্লা শহরে। তার পদায়ন হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার খড়িয়ালা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রাফি মেজো। বড় বোন মেরিন তানজিনা আহমেদ চাকরিজীবী। ছোট বোন ছামিয়া ফেরদৌস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়র ছাত্রী। রাফির বাবা-মা দুইজনেই শারীরিকভাবে অসুস্থ। বাবা জামসেদ উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত। মা রোহেনারা বেগম ভুগছেন ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে। রাফির স্ত্রী ডা. রুবানা জাহান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা।
নিজেদের শারীরিক অসুস্থতায় ছেলেকে কাছে না পাওয়ার কোনো দুঃখ নেই রাফির বাবা-মায়ের মনে। ছেলে দেশের তরে কাজ করছেন তাতেই গর্বে বুক ভরে যায় তাদের।
রাফির মা রোহেনারা বেগম বলেন, আমাদেরও ইচ্ছা করে ছেলেকে কাছে রাখতে। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তো আমি আমার ছেলেকে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারি না। আমি আরও উৎসাহ দিয়েছি আমার ছেলেকে। চিকিৎসক হিসেবে সে তার দায়িত্ব পালন করবে- এটাই স্বাভাবিক। ভয় নয়, আমার ছেলে মানুষের জন্য কাজ করছে ভেবে আমাদের অনেক গর্ব হয়।
পরিবারের সঙ্গে ডাক্তার রাফি- ছবি জাগো নিউজ।
ডা. মো. আকিব জাভেদ রাফি বলেন, আমার এখন অসুস্থ বাবা-মায়ের পাশে থাকার কথা ছিল। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে দেশের ক্রান্তিলগ্নে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। দেশের মানুষের সেবায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমার অসুস্থ বাবা-মা, আমার স্ত্রী ও দুই বোন প্রতিনিয়ত আমাকে করোনাকে ভয় না করে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রথম ধাপে আমরা ছয়জন চিকিৎসক আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করেছি। রোগীদের ওষুধ খাওয়ানোসহ সেবা দেয়ার পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সার্বক্ষণিক রোগীদের সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করেছি। রোগীদের নমুনাও সংগ্রহ করতে হয়েছে। করোনা আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে আমি মারা গেলেও কোনো দুঃখ থাকবে না।
আরেক করোনাযোদ্ধা তাসফিয়ার বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলায়। তবে বর্তমানে তারা ঢাকার আদাবর এলাকায় বসবাস করেন। তাসফিয়ার বাবা তৈয়ব উদ্দিন আহমেদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি দীর্ঘদিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। আর মা সুফিয়া বেগম একজন গৃহিণী। একমাত্র ভাই সাফায়েত আহমেদ একজন ফার্মাসিস্ট। তাসফিয়ার স্বামী ওয়াসিম আকরাম সেনাবাহিনীর একজন মেজর।
তাসফিয়া বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সরকারি চাকরির প্রথম পদায়ন হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউয়িন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। চাকরির বছর যেতে না যেতেই দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাসফিয়াকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে ভয় নয়, ১৫ মাসের একমাত্র সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে তাকে। তবে পরিবারের সহযোগিতায় সব বাধা পেরিয়ে তাসফিয়া নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছেন করোনাযুদ্ধে।
তাসফিয়ার পরিবারও তার এই কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের জন্য কাজ করা করোনাযোদ্ধা মেয়ের জন্য এখন গর্ব হয় তাদের।
স্বামী-সন্তানের সঙ্গে চিকিৎসক তাসফিয়া-ছবি জাগো নিউজ।
তাসফিয়ার বাবা তৈয়ব উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি ১৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গেছি। আর আমার মেয়ে ২৬ বছর বয়সে করোনাযুদ্ধে আছে। আমরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম তেমনি আমার মেয়েসহ চিকিৎসকরা করোনাযুদ্ধে জয়ী হবে বলে বিশ্বাস করি। আমরা যেহেতু দূরে থাকি সেহেতু প্রথমে একটু ভয় লাগতো। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে যেভাবে সহযোগিতা করছে; তাতে করে আমাদের ভয়টা কেটে গেছে। আমার সন্তানের জন্য গর্ববোধ করি।
ডা. তাসফিয়া আহমেদ বলেন, চাকরিতে ঢুকেই এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যেটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তবে আমরা সবসময় মানুষকে সেবা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আইসোলেশন সেন্টারে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় দায়িত্ব পালনকারীদের তালিকায় আমার নাম দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। কারণ আমার ছোট বাচ্চার জন্য দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য সমস্যা ছিল। আমার স্বামীও এখানে থাকে না। তাই ছোট বাচ্চাকে রেখে কীভাবে দায়িত্ব পালন করব সেটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। বাবা-মা আমাকে সাহস দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমাদের ঊর্ধ্বতনরাও নিয়মিত খেঁজখবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন। সেজন্য এখন আর ভয় লাগে না।
বয়সে এবং চাকরিতে নবীন চিকিৎসকরা যেভাবে করোনাভাইরাসের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে নিজেদের সপে দিয়েছেন; সেটি ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তাদের ঊর্ধ্বতনরা। তারাও নবীন এসব চিকিৎসকের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ব্রাহ্মণাবড়িয়া জেলায় দেড়শ চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই দৃঢ় মনোবল নিয়ে তারা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের সবধরনের সহযোগিতা করছি। সবসময় তাদের মনোবল চাঙা রাখার চেষ্টা করছি। আশা করি; আমরা সবাই মিলে এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারব।
এএম/এমএস