দূর প্রবাসে থাকলেও ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না কাজলের সংসারে
গাজীপুরের শ্রীপুরে গত ২৩ এপ্রিল নিজ বাড়ি থেকে প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ও তিন সন্তানের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনার পরপরই দেশে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পুলিশ, র্যাব, পিবিআইসহ দেশের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনার রহস্য উদঘাটনে তদন্তে নামে। অবশেষে পিবিআই ঘটনার সম্পৃক্ততায় স্থানীয় পারভেজ নামের একজনকে আটক করে এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। পরে অধিকতর তদন্তে ঘটনার সাথে পারভেজসহ আরও পাঁচজন জড়িত ছিল বলে জানায় র্যাব। ঘটনা যাই হোক নিজ স্ত্রী ও সন্তান হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন জানান মালয়েশিয়া প্রবাসী রেজোয়ান হোসেন কাজল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মালয়েশিয়া থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের অনলাইন প্রযুক্তির কল্যাণে সবসময় খোঁজ রাখতেন। খাবার খেয়েছে কিনা, স্কুলে যাওয়া হলো কিনা, গোসলসহ প্রতিটি মুুহূর্তে কী করছে, এসব নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। তার ছেলে ফাদিল ছিল বাকপ্রতিবন্ধী। সে এ হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও নিজ হাতে কাগজ দিয়ে ঘুড়ি বানিয়ে বাবাকে ভিডিও পাঠিয়েছিল। প্রতিমুহূর্তের আপডেট সন্তানরা তার বাবাকে দিত। আজ কতদিন হয়ে গেল পরম মমতা নিয়ে কেউ আর তার সাথে কথা বলে না। স্ত্রী-সন্তান হারানোর ব্যথা তো ভুলে যাওয়ার নয়, এ এক অমানুষিক যন্ত্রণা যা তাকে দূর প্রবাসেও কুঁকড়ে কুঁকড়ে খাচ্ছে। যাদের নিয়ে তার ভালোবাসার সংসার সেজেছিল তাদের শেষ মুখটাও না দেখারও আক্ষেপটাও বেড়েছে তার।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের রেজোয়ান হোসেন কাজল। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে বাবা-মায়ের বড় সন্তান তিনি। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাসের পর সংসারের সচ্ছলতা আনতে ছুটে যান মালয়েশিয়ায়। একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কনস্ট্রাকশনের কাজে যোগ দেন। সেখানে প্রকৌশল বিভাগে অধ্যয়নরত স্মৃতি ফাতেমার সাথে প্রথমে তার হয় পরিচয়। পরবর্তীতে সেই পরিচয় ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে বাস্তবে রূপ নেয় পরিণয়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় নিজ দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়া যাওয়া স্মৃতি ফাতেমার উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন।
২০০৪ সাল, মালয়েশিয়ায় কাজল-ফাতেমা দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় প্রথম কন্যাসন্তান সাবরিনা সুলতানা নুরা। ওই বছরই নিজ দেশ ইন্দোনেশিয়ার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভালোবাসার টানে স্বামীর দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন ফাতেমা। কাজল স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ওঠেন বাবার বাড়িতে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী ফাতেমা ও সন্তান নুরাকে রেখে ফের জীবিকার সন্ধানে প্রবাসে ছুটে যান কাজল।
প্রবাসে কাজ করলেও প্রতিমুহূর্তে দেশেই স্ত্রী-সন্তানদের কাছে পড়ে থাকত তার মন। বছর বছর তাই ছুটি নিয়ে ছুটে আসতেন ভালোবাসার প্রিয় স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে। এরই মাঝে জন্ম নেয় হাওয়ারিন ও ফাদিল। সন্তানদের লেখাপড়ার মাধ্যমে মানুষ করে গড়ে তুলতে সুন্দর একটি সংসারের স্বপ্ন দেখতেন কাজল ও তার স্ত্রী।
তাই প্রবাসের কষ্টার্জিত আয়ের টাকায় গাজীপুরের শ্রীপুরের আবদার এলাকায় এক টুকরা জমি কিনে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কাজল প্রবাস থেকে টাকা পাঠাতেন, আর তার স্ত্রী ফাতেমা নিজ ব্যবস্থাপনায় সব কাজ করতেন। তারা গড়ে তুলেছিলেন দোতলা পাকাভবন। সন্তানদের লেখাপড়া ও তার বাবা-মায়ের খোঁজ রাখা, সবই ফাতেমা নিপুণ হাতে করতেন। এসব নিয়ে সবসময় গর্ব করতেন কাজল। স্ত্রী ও সন্তানরা প্রিয় মানুষটিকে বারবার দেশে আসার জন্য আকুতি জানাত। স্ত্রী-সন্তানদের ভালোবাসার কাছে হেরে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আগামী বছরেই স্থায়ীভাবে ফিরে আসবেন দেশে। দেশে ফিরে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর আগেই সবাই কাজলকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই দূর প্রবাসে নিজ ভালোবাসার স্বজনদের হারিয়ে লকডাউনে ঘরবন্দি কাজলের বুকচাপা কান্নায় প্রকৃতির পরিবেশও মাঝে মধ্যে ভারী হয়ে আসে।
প্রবাসে অবস্থানরত কাজলের সাথে অনলাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে কথা বলে জানা যায়, মেধাবী স্মৃতি ফাতেমা ভালোবাসার টানেই সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে চলে এসেছিল। সে জলাঞ্জলি দিয়েছিল নিজের সকল স্বপ্ন। বিয়ের পর সে আমাকে ও আমার সন্তানদের নিয়েই ভেবে দিন কাটাত। সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিল সে। যেমন মেধাবী তেমনি ছিল ধার্মিক। সন্তানদের সেভাবেই গড়ে তুলছিল। সে রমজানে দান সদকা করার জন্য টাকা পাঠানোর আকুতি জানিয়েছিল, টাকাও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দান সদকা করার আগেই সে টাকাই কাল হয়ে উঠল। দূর প্রবাসে থাকলেও সংসারে প্রেম ভালোবাসার কোনো ঘাটতি ছিল না। শান্তির সুবাতাসে মুগ্ধ এই পরিবারে একদিনের জন্যও কোনো অশান্তি হানা দিতে পারেনি।
কাজল জানান, এমন স্বজন হারানোর পরও প্রবাসে করোনার প্রভাবে লকডাউনেও ঘরবন্দিত্ব জীবন যে কত কষ্টের তা বলার নয়। এখন পর্যন্ত যে তিনি বেঁচে আছেন মাঝে মধ্যে তা বিশ্বাসই হচ্ছে না। তার নিজের কোনো স্বপ্ন আর অবশিষ্ট নেই, তবে একটি আশা নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন যারা তার ভালোবাসার সারথিগুলোর ওপর বর্বরতা চালিয়ে অঙ্কুরে নিমেষ করেছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবে সরকার।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে নিজ বাড়ি থেকে প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ও তিন সন্তানের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে পিবিআই এ ঘটনার মূলহোতা পারভেজ নামের এক কিশোরকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মা-সন্তানদের খুনের কথা স্বীকার করলে আদালতে ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি নেয়া হয়।
যদিও র্যাবের ব্যাপক অনুসন্ধানে এ ঘটনায় জড়িতের অভিযোগে আরও পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযুক্ত পারভেজ বর্তমানে টঙ্গীর কিশোর অপরাধ সংশোধনী কেন্দ্রে থাকলেও অন্য পাঁচ অভিযুক্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
শিহাব খান/বিএ/জেআইএম