ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ভয় করে বাইরে যেতে, ডিউটির পর বাসায় ফিরতে

বেনাপোল (যশোর) | প্রকাশিত: ০১:৪১ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২০

যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলা ও বেনাপোল পোর্ট থানার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তার মধ্যে পরিবারের সঙ্গে থেকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আতঙ্ক আরও বেড়েছে উপজেলা সদর, নাভারন হাসপাতাল ও বেনাপোলের বোয়ালিয়া গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী ও এক স্বাস্থ্যকর্মীর ছেলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায়।

দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল হয়ে আসা ভারতফেরতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইনে রাখা ও তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করছেন তারা।

এছাড়া উপজেলায় কর্মহীন, অসহায়, বেকার হয়ে পড়া লোকজনকে ত্রাণ দেয়া, বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, মোবাইল কোর্ট চালুসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাদেরই। এসব করতে গিয়ে তারা নিজেরা যেমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তেমনি তাদের সঙ্গে থাকা পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। তাদেরই কয়েকজন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা জানিয়েছেন।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পুলক কুমার মন্ডল বলেন, ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমরা উপজেলা প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠপর্যায়ে কাজ করছি। ভারতে আটকে পড়া লোকজনকে দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। ভারতেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ঝুঁকি থাকলেও তাদের নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তাদের প্রশাসনিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তাদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে। তাই মনে ভয় তো আছেই। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করতে গিয়ে এ এলাকার দুই-তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও সর্বাধিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করছি। কারণ চাকরিতে ঢোকার পর এটা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। দেশের জন্য কাজ করাটাই আমার ব্রত।

jagonews24

পরিবার-পরিজন সম্পর্কে তিনি বলেন, ঝুঁকির কারণে এক মাস হলো পরিবার থেকে দূরে আছি। পরিবারের সদস্যরা যশোর শহরে থাকেন। তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। তবে কথা হয়। পরিবার থেকে বারবার সতর্ক করছে। আমিও তাই সতর্ক থেকে কাজ করছি। তবে অনেকেই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে থাকেন। এটা একটা চিন্তার বিষয়।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খোরশেদ আলম চৌধুরী তার ফেসবুকে লিখেছেন কাজের অভিজ্ঞতা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে অনুভূতির কথা।

সত্যিই এখন আমার ভয় করে বাইরে যেতে, ডিউটির পর বাসায় ফিরতে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হব, এ পেশার প্রতি খুব শ্রদ্ধা ও ফ্যাসিনেশন ছিল। নিজেকে এ পেশায় বিলিয়ে দিতে কখনও পিছপা হব না। এই করোনাযুদ্ধে নিজের শেষটুকু দিয়ে লড়ে যেতে চাই। হয়তো জনসাধারণকে সচেতন করতে পারলেই এ যুদ্ধে আমরা জয় হতে পারবো। তাই তিনি সকলকে নিজ ঘরে থাকতে অনুরোধ করেন। পাশাপাশি অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করেন। আর কেউ যদি বের হন, তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক, গ্লাভস পরে বের হতে বলেন।

নিজের ছোট ছেলে ও পরিবারকে বাসায় রেখেও প্রতিদিন করোনা বিস্তার প্রতিরোধ, ভারত থেকে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরা, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, মোবাইল কোর্ট, বাজার মনিটরিং, মানুষকে নিজ ঘরে অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ছুটে চলছি উপজেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। আমার নিজের খাওয়া-ঘুম বাদ দিয়ে ডিউটিতে যাই সমস্যা নেই, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একদমই ভিন্ন, মানুষকে বুঝিয়ে, অনুরোধ করে, জরিমানা করেও ঘরে রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না। এখন আমি আমার পরিবারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমার মাধ্যমে যদি ভাইরাস বাসায় নিয়ে যাই তো আমার ছেলের ও পরিবারের কী হবে? তবুও আমি ডিউটি করছি। পালাইনি। পালাবও না। ভয় করে ছেলেকে চুমু দিতে, কোলে নিতে। নিজের নিঃশ্বাসকেই বিষাক্ত মনে হয়। তার মধ্যে পিপিই পরে বাইরে রোদের মধ্যে কাজ করাও বিশাল এক যন্ত্রণা! মাস্ক পরে দম কেমন বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিটি ডিউটিই এমন মানসিক আর শারীরিক কষ্টে ভরা।

আর একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান। তিনি বলেন, ইউএনও, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাথে সার্বক্ষণিক পাশে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। সেই সাথে করোনার মধ্যে মাদক পাচাররোধে, এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করে চলেছেন। যেখানেই সমস্যা সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন। প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে চলেছেন তিনি। পরিবার পরিজন রয়েছেন খুলনায়। কতদিন যাননি বাড়িতে সেটা ভুলে গেছেন। কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে পরিবারের কথাও ভুলে যান। আমরা বড় বড় দুর্যোগ দেখেছি। এমন মহামারি দেখিনি। সারা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে করোনাভাইরাস। থানার অন্যান্য পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলরা আমাদের সাথে দিনরাত সমানভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাদের অনেকেই পরিবার নিয়ে থাকেন। তাদের বলে দেয়া হয়েছে ভালো করে পোশাক খুলে জীবনানাশক ছিটিয়ে নিজেকে জীবানুমুক্ত করে বাড়িতে যাবেন। তারপরও দূরত্ব বজায় রাখবেন। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমাকে জানাবেন।

বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার আব্দুল আজিজ বলেন, ভারত থেকে ফেরা প্রত্যেক যাত্রীর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কিনা, করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে কিনা, সেসব দেখার দায়িত্ব আমাদের। এসব করতে গিয়ে আমাদের তিন সহযোগী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারপর বলেন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে।

jagonews24

ভারত থেকে আসা যাত্রীদের বাসায়, নাকি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা উচিত, নাকি হাসপাতালে পাঠাতে হবে এসব নির্ণয় করতে হয়। এখানে ঝুঁকি তো থাকবেই। তারপরও সেবার মানসিকতা নিয়ে চাকরিতে এসেছি। সরকার সুরক্ষার জন্য হ্যান্ড গ্লাভস, মাক্স ও পিপিই দিয়েছে। এরপরও অজানা এক আতঙ্ক মনে কাজ করে। তাই আপাতত পরিবার থেকে দূরে থাকছি।

ভারত ফেরতদের মধ্যে যাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখার দরকার তাদের রাখা হচ্ছে ‘বেনাপোল পৌর বিয়ে বাড়িতে’। সেখানে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী ডাক্তার আব্দুল মান্নান দায়িত্ব পালন করছেন।

ডাক্তার আব্দুল মান্নান বলেন, তিন শিফটে তিনজন করে আমরা এখানে দায়িত্ব পালন করি। সতর্কতার সঙ্গে কাজ করি। তবুও ঝুঁকি তো রয়েছেই। দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় যাই। সেখানে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে থাকি। সাবধানে থাকার চেষ্টা করি। তারপরও ভয়তো থেকেই যাচ্ছে। একমাত্র চিকিৎসকের পরিবারই জানে এসময় চিকিৎসক ও তাদের পরিবার কতটা ঝুঁকিতে আছেন। দূরে থেকে অনেক কথাই বলা যায়। আমাদের জন্য দোয়া করবেন আমরা যেন পীড়িত মানুষের পাশে থেকে সেবা দিয়ে যেতে পারি নিরন্তর। ভয়ে যেন না পালাই এ রণক্ষেত্র ছেড়ে।

জামাল হোসেন/এমএএস/বিএ