বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা, সন্দেহ হলেই নমুনা সংগ্রহ
লকডাউনের কারণে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার অন্যান্য এলাকার মতোই ঘরবন্দি মুলাইদ গ্রামের মানুষ। সকালে ঘুম থেকেই উঠেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী রফিকুল ইসলাম ব্যক্তিগত সুরক্ষার পোশাক পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাড়ির কেউ অসুস্থ আছেন না কি? কেউ অন্য কোনো জেলা বা বিদেশ থেকে এসেছেন কি-না? কারও সর্দি, জ্বর বা ঠান্ডা আছে কি-না? খোঁজ নিচ্ছেন। বাড়ির লোকজনও ভেতর থেকে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
আর এভাবেই গাজীপুরের শ্রীপুরে করোনার সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ সময় যদি করোনা উপসর্গসহ কোনো রোগী পাওয়া যায় তাহলে দ্রুত যোগাযোগ করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে হাজির হচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা। সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আইইডিসিআরে।
উপজেলাব্যাপী এই বিশাল কর্মযজ্ঞে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রণয় ভূষণ দাসের সমন্বয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক এএসএম ফাতেহ্ আকরাম। এছাড়াও আইইডিসিআর থেকে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহকারী ওই রোগীর হোম কোয়ারেন্টাইনেও বিশেষ নজরদারিও করছেন তারা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেয়া তথ্য মতে, শিল্প এলাকাবেষ্টিত শ্রীপুর উপজেলায় বিপুল সংখ্যক মানুষের বসবাস। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা দেয়ার লক্ষ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যা উন্নীত করার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও শতভাগ জনবল নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমানে মোট ১০ জন চিকিৎসক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫২টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও পাঁচটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে দেড় শতাধিক মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী দিন রাত সেবা দিচ্ছেন। বিশেষ করে দেশে করোনা ‘সংক্রমণের পর উপজেলার কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ডাক্তার ও চিকিৎসক সংকটে সাধারণ চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়ার পর সরকারি চিকিৎসকদের মানবিক দায়িত্ব যেন বেড়ে গেছে। এখন উপজেলার সাধারণ মানুষের অন্যতম ভরসা কেন্দ্র হয়ে উঠেছে সরকারি এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি।
এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তরুণ চিকিৎসক এএসএম ফাতেহ্ আকরাম এক বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে। তিনি বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের আশা ভরসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো। আমরা মানুষের আশাকে ভেঙে দিতে পারি না। প্রথম প্রথম ভয় হলেও আমরা চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত সকলেই এক সঙ্গে বসে শপথ নেই, যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন আমরা কেউ পিছপা হবো না। মৃত্যুকে হাতে নিয়েই চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
এএসএম ফাতেহ্ আকরাম বলেন, সবার ভয় দূর করার জন্য আমি নিজেই করোনার উপসর্গধারী রোগীদের নমুনা সংগ্রহ শুরু করি। এখন সবার মধ্যে ভয় দূর হয়ে গেছে। আমরা করোনাকে পরাজিত করে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে চাই।
তিনি জানান, এ পর্যন্ত শ্রীপুর উপজেলা থেকে মোট ১২৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৪জন রোগীর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। এখন ওইসব করোনা পজেটিভ রোগীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে বের করে তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। করোনা পজিটিভ রোগীদের সাতদিন অন্তর অন্তর নেগেটিভ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়াও যারা করোনা সংক্রমণ এলাকা থেকে এসেছেন তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হচ্ছে।
এএসএম ফাতেহ্ আকরাম আরও জানান, নিয়মিত কাজের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ রোধে আমরা দুই ধরনের পরিকল্পনা করছি। প্রথমে করোনা রোগীদের ব্যবস্থাপনা ও পরে রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে তার জন্য বাড়ি বাড়ি কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। এ জন্য তৃণমূলের মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিটি ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি ঘুরে অসুস্থ ব্যক্তিদের খবর নেন, চিকিৎসা দেন। করোনা উপসর্গ থাকলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করেন। শিল্প কারখানার শ্রমিকদের কারণে এসব কাজ কঠিন হলেও অধিক শ্রমের কারণে এখন পর্যন্ত সফল স্বাস্থ্যকর্মীরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রণয় ভূষণ দাস বলেন, শত প্রতিকূলতায়ও অন্তত চিকিৎসকদের পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা সেই শপথটি নিয়ে করোনা যুদ্ধে নেমেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এখন দিন রাত খোলা রয়েছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমাদের স্লোগানই হচ্ছে ‘সবাই বাড়িতে থাকুন, অসুস্থ হলে আমাদের জানান, হাসপাতালে না আসলে বাড়িতেই চিকিৎসা দিব’। যত বাধাই আসুক উপজেলার প্রতিটি লোকের মৌলিক চাহিদা চিকিৎসা নিশ্চিতে পিছপা হবে না আমাদের টিম।
তিনি আরো জানান, করোনা সংক্রমণ হওয়ার পরই উপজেলার বেশীরভাগ বেসরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, এটা দুঃখের বিষয়। সরকারের সিদ্ধান্ত মতে সকল বেসরকারী হাসপাতালগুলো খোলা রেখে চিকিৎসা দেয়ার বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন মো. খায়রুজ্জামান বলেন, প্রতিটি বাড়ি বাড়ি নজরদারির মাধ্যমে আমরা করোনা সংক্রমণ রোধের একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। এর ফলে যেমন কেউ চিকিৎসা বঞ্চিত হবে না তেমনি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই করোনায় আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে পারবো।
শিহাব খান/আরএআর/জেআইএম