স্বীকৃতি পাওয়ায় গর্বিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীরাঙ্গনারা
দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও ৪৪ বছর লোক লজ্জার ভয়ে অন্তরালে ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীরাঙ্গনারা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়ায় সম্মান হারানোর যন্ত্রণা, দারিদ্রতা আর সামাজিক বৈষম্যের কষ্ট ভুলে তারা এখন গর্বিত, স্বপ্ন দেখেছেন নতুন জীবনের।
সম্প্রতি ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে ১১ জন হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার। এদের মধ্যে জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নেই রয়েছেন ৯ জন।
সরেজমিনে বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বড়বঙ্গেশপুর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, লালাপুর, সাহাপুর ও নরশিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় এ সকল বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে। এ সময় তাদের অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, ওই সময় সবকিছু হারিয়ে সমাজ থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিলাম। তবে দেরিতে হলেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের স্বীকৃতি দেওয়ায় আমরা গর্বিত।
১৯৭১ এর ২২ নভেম্বর নরশিয়া গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী রাবিয়া বেওয়ার উপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। তার স্বামীও জানতেন না স্ত্রী একজন বীরাঙ্গনা। রাবিয়ার শ্বশুর বিষয়টি জানলেও লোক লজ্জার ভয়ে গোপন রেখেছিলেন নির্মম এই সত্যটি। কিন্তু যখন অপ্রিয় এই সত্যটি জাতির সামনে উম্মোচিত হলো সেদিন রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করেছে বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাবে।
মুক্তিযোদ্ধা রাবিয়া জাগো নিউজকে জানান, ফজরের আজানের পর গ্রামে আক্রমণ করে পাক হানাদার বাহিনী। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে কয়েকজনকে। ভয়ে ওই এলাকা থেকে পালিয়ে যান আমার স্বামী। পরে তারা আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার শ্বশুরসহ আমাকে ও আমার ভাবীকে মারধর করে। পরে ৩ জন পাঞ্জাবি আমার উপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন। সম্মানের কথা চিন্তা করে আমার শ্বশুর ও ভাবী (ভাশুরের স্ত্রী) ঘটনাটি জানায়নি আমার স্বামীকে। কিছু দিন পর স্বামী মারা যাওয়ার পর ধান কুড়িয়ে, মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছি।
বিয়ের মাত্র ৩ মাস পরেই পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর কয়েকজন বর্বর সেনা সদস্য একই রকম নির্যাতন চালায় সাহাপুর গ্রামের হাজেরা বেগমের উপর। ওই ঘটনার পর স্বামীও পরিত্যাগ করে হাজেরাকে।
এ দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদাররা একই গ্রামের আরবী বেগমকে চৌডালা এলাকায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালায় । এ সময় তিন মাস বয়সী সন্তান দুধের অভাবে মারা যায়। সুযোগ হয়নি মৃত শিশুটির দাফন কাফন করার। শুধু তাই নয় গুলি করে হত্যা করে তার স্বামীকেও।
তবে অন্য বীরাঙ্গনাদের চেয়ে সৌভাগ্যবতী নরশিয়া গ্রামের রেনু বেগম। পাক সেনাদের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পরেও কাছে টেনে নেন তার স্বামী। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টিকেনি তার কপালে। স্বামীর মৃত্যুর পর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতে হয় তাকে । এখন বয়সের ভারে কাজ করতে না পারায় নেমেছেন ভিক্ষা বৃত্তিতে।
একই গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অয়েজউদ্দীন ও বীরাঙ্গনা রাহেলা বেগম এর ছেলে তাইফুর রহমান জানান, আমার চোখের সামনে বাবাকে পিটিয়ে শরীরের হাড় ভেঙে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আহত করা হয়। পরে হাত পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়া হয়। আর আমার মায়ের উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। তারপর গ্রামের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
এ সকল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই এলাকার বেনু মিয়া সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা স্মরণ করে জাগো নিউজকে জানান, ২২ নভেম্বর স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় রহনপুর থেকে এসে আমাদের এলাকায় নারী ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ চালায়। আমাদের এই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে তারা আক্রমণ চালায়। এ সময় ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩৫ জনকে হত্যা করে রাজাকার আর পাকবাহিনী। পরে খবর পেয়ে মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালালে পিছু হটতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। কিন্তু তার আগেই অনেক বীরাঙ্গনার সম্ভ্রম লুটে নেয়। এর মধ্যে ৯ জনের নাম প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই লোক লজ্জার ভয়ে এই ঘটনা আজও প্রকাশ করেনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও এসব বীরঙ্গনারা তাদের মতোই বীর, তারাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সামাজিক লোক লজ্জা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির শিকার এসব নারীরা ডুকরে কেঁদেছেন নিজের আঁচল তলে। স্বাধীনতার পরই যদি তাদের সম্মান জানানো যেত তাহলে তাদের এতোদিন কষ্ট করতে হতো না। তবে এখন সময় এসেছে দেশের সকল বীরঙ্গনাদের সম্মান জানানোর।
এসএস/এমএস