মাঠভরা সোনালী ধান নিয়ে শঙ্কায় হাওরের কৃষকরা
সুনামগঞ্জের হাওর জুড়ে এখন সোনালী ধান। হাওরের পানি অনেকটা দেরিতে নামায় বেরো ধানের চাষাবাদও শুরু হয় কিছুটা বিলম্বে। মাঠভরা সোনালী ধান থাকলেও কৃষকের চোখেমুখে এখন আতঙ্ক। একদিকে করোনাভাইরাসের জন্য ধান কাটার শ্রমিক নেই। অন্যদিকে ভারি বৃষ্টিপাতের সর্তকবার্তা দিচ্ছে প্রশাসন। ফলে মাঠে বাম্পার ফলন হলেও আনন্দ নেই কৃষকের মনে।
তাছাড়া সরকার থেকে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার জন্য যন্ত্রপাতি দিলেও সেটা জোটে না সবার কপালে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে ধান কাটার শ্রমিক আনতে কয়েকটি জেলার কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তারা। ইতোমধ্যে শ্রমিকও আসতে শুরু করেছে সুনামগঞ্জে।
জেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্য মতে, এ বছর জেলার ১১টি উপজেলার ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে দুই লাখ ২০ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। যার মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ১৬ হাজার ১৬২ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেরায় ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর, ধর্মপাশা উপজেলায় ৩১ হাজার ৭২০ হেক্টর, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার ৪৬৫ হেক্টর, তাহিরপুর উপজেলায় ১৭ হাজার ৫২৭ হেক্টর, দিরাই উপজেলায় ২৭ হাজার ৭৭৬ হেক্টর, শাল্লা উপজেলায় ২১ হাজার ৮৮২ হেক্টর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২২ হাজার ৩৩৯ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলায় ২০ হাজার ৬১০ হেক্টর, দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১২ হাজার ৯৬০ হেক্টর এবং ছাতক উপজেলায় ১৪ হাজার ৭০২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। সেখানে ধানের উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ মেট্রিক টন।
সরজমিনে সুনামগঞ্জের বেশ কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায়, মাঠে রয়েছে সোনালী ধান। বাংলাদেশের তিন মাসের খাদ্য যোগান দেয় এ জেলা থেকে উৎপাদিত ধান। কিন্তু মাঠে ধান থাকলেও একার পক্ষে ধান কাটার সামর্থ্য নেই কৃষকদের। প্রতিবছর বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়ে এলেও এবার অতিরিক্ত মজুরি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ৪.০৩ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। কৃষকদের দাবি ধান কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি যদি দেওয়া হয় তাহলে দ্রুতই মাঠ থেকে ধান ঘরে নিয়ে আসতে পারবেন তারা। তা না হলে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিতে সব ধান পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরে বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক মাসুক মিয়া বলেন, ‘আমার ১৫ কিয়ার জমিত এইবার বোরো ধানের খেত করছিলাম। আমার পক্ষে তো একলা সব ধান কাটা সম্ভব না। অন্যবার ৫০০ টাকা দিয়া রোজ মানুষ রাখতাম এইবার ১০০০ টাকা দিয়াও মানুষ পাইলাম না।’
একই হাওরের কৃষক মুজিবুর আহমেদ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ধান ভালা হইছে। কিন্তু ধান কাটারতো মানুষ পাইলাম না। শুনছি সরকার থকি যন্ত্রপাতি দিবো কিন্তু আমরা তো পাইতাম না। যারা সম্পর্ক ভালা তারা পাইবো, ধান কাটার মানুষ না পাইলে যে বৃষ্টি শুরু হইছে সব ধান পানির তলে যাইবো পরে পথে বওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই।’
ধর্মপাশা উপজেলার চামরদানী ইউনিয়নের বিচরাকান্দা গ্রামের কৃষক আহম্মদ আলী বলেন, ‘বাহির জেলা থকি বেপারিদের (শ্রমিক) সঙ্গে কথা হইছিলো তারা কইলো গাড়ি নাই কেমনে আইতাম, এখন যাও যারা আছে তারা ৫০০-৭০০ টাকা বেশি দাবি করছে। তার মধ্যে যে মেঘ শুরু হইছে হাওরের বাঁধ ভাইঙ্গা পানি ডুকিয়া কষ্টের ধান নষ্ট অইবো। আমরা ছেলে মেয়ে নিয়া পথে বইমু।
এদিকে ধান কাটার শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বালু শ্রমিক, পাথর শ্রমিকসহ যারা লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাদের ধান কাটার আহ্বান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যারা খেতে ধান কাটতে যাবেন তাদের সরকারি রিলিফ দেয়া হবে। রাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে থাকার ব্যবস্থাও করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. সফর উদ্দিন জানান, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক সুনামগঞ্জে ধান কাটতে আসত। এবার করোনা ভাইরাসের কারণে শ্রমিক আসা কমে গেছে। তবে বোরো ধান কাটার জন্য দেশের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ভোলা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ কয়েকটি জেলার কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগযোগ করেছি শ্রমিক আনার ব্যাপারে। বর্তমানে ৩ হাজার ৪৪৩ জন ধান কাটার শ্রমিক আছেন। আরও ১২ হাজার ২৯৪ শ্রমিক কয়েক দিনের মধ্যে চলে আসবেন। স্থানীয়ভাবে অন্য পেশার লোকজনও ধান কাটা শুরু করেছেন। আশা করছি শ্রমিক সংকট কিছুটা হলেও কমে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে।
তিনি বলেন, আমাদের কৃষি বিভাগের ৯২টি কম্পাইন হার্ভেস্টার, ১৯টি রিপার সচল আছে। নতুন করে সরকার থেকে নতুন ৪০টি হার্ভেস্টার ও ২৭টি রিপার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এগুলো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে লাগানো হবে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ বলেন, কৃষকদের উৎসাহ দিতে আমি নিজেও হাওরে ধান কেটে এসেছি। অন্য পেশার শ্রমিকদের ধান কাটতে আসার জন্য আমরা উৎসাহ প্রদান করছি। শ্রমিক প্রণোদনা হিসেবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার পিস সাবান, ১০ হাজার পিস বিস্কুট বিতরণ করা হবে। কৃষি যন্ত্র মেরামতের জন্য কৃষকদের সুবিধর্তে কামারের দোকান ও ওয়ার্কশপ খোলা রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছি। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দ্রুত ধান কাটার জন্য কৃষকদের বলা হচ্ছে। আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে হাওরের ফসল কেটে কৃষকের ঘরে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
জেলা সির্ভিল সার্জন ডা. মো. শাসম উদ্দিন বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষদের ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বলা হলেও সুনামগঞ্জ যেহেতু বোরো আবাদের এলাকা তাই আমরা সবাইকে বলব সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং বাহির জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে এলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে মাঠের কাজে নিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে প্রতি উপজেলায় শ্রমিকদের জন্য ১টি করে মেডিকেল টিম গঠন করেছি।
এফএ/পিআর