গরিবের বন্ধু ডা. মঈনকে জাতীয় বীর ঘোষণার দাবি
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রামে গিয়ে অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিতেন করোনাভাইরাসের (কোভিড ১৯) সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দীন। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ সহকারী অধ্যাপকের মৃত্যুতে তার জন্মস্থান সুনামগঞ্জের ছাতকের সেই নিম্ন আয়ের মানুষের চোখ এখন অশ্রুসিক্ত।
অসহায়দের বিনামূল্যে ওষুধও দিতেন। কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত ওষুধের স্যাম্পল তিনি বিলিয়ে দিতেন এলাকার অসহায় রোগীদের মধ্যে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শুধু এলাকার অসহায় মানুষদেরই সেবা দিতেন না মঈন উদ্দিন সিলেটের চেম্বারে এলাকার কেউ গেলে তাদেরও বিনামূল্যে সেবা দিতেন। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ এমন গরিবের বন্ধু চিকিৎসককে হারিয়ে শোকে পাথর। এমন একজন চিকিৎসক রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন অনেকেই।
ডা. মঈনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নজন স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কামরুল হাসান নামে একজন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘করোনা যুদ্ধে মানবতার সেবা করতে গিয়ে ডা. মঈন উদ্দিন সাহেব পরাজিত হয়েছেন। তার জন্য কী রাষ্ট্র কিছু করতে পারে না....? তার সম্মানে প্রতিটি মেডিকেলে কালো পতাকা উড়িয়ে সম্মান জানানো হোক।’
তিনি আরও লেখেন, ‘যেহেতু তাকে (ডা. মঈন উদ্দিন) WHO এর নির্দেশনা ফলো করে দাফন করা হবে। তাই সাধারণ জনগণ সরাসরি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাবে না। তাই তাকে রাষ্ট্রীয় বীর ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক।
ডাক্তার, নার্স, পুলিশসহ স্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্যই এই মহামারি মোকাবিলায় প্রকৃত যোদ্ধা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেউ শহীদ হলে সবার প্রতি এ রকম শ্রদ্ধা আমরা কি জানাতে পারি না?
স্যালুট জানাই মানবতার সেবায় নিয়োজিত প্রত্যেক সদস্যের প্রতি।’
ডা. মঈন উদ্দিনের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা মো. নিজাম উদ্দিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ডাক্তার মঈন উদ্দিন সাহেবের জানাজা দাফন যেন তার গ্রামেই হয়। অনন্ত তার আত্মীয় প্রিয়জন যেন তার কবরে দু’ফোটা অশ্রু ঝরিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।’
ডা. মঈন উদ্দিনের বাবা মুনশি সিকদার আলী ছিলেন একজন পরহেজগার আলেম। তার তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন ডা. মঈন।
চিকিৎসা পেশায় যোগদানের পর তিনি এলাকার মানুষদের ভুলে যাননি। গ্রাম থেকে লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়া মঈন উদ্দিন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে সিলেট থেকে এলাকায় ছুটে যেতেন। বিনামূল্যে গরিব অসহায়দের ব্যবস্থাপত্র দিতেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পও করেছেন তিনি। এমন মানবিক মানুষ মানুষের সেবা করতে গিয়েই মারা গেলেন।
এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মো. আছকির আলী বলেন, ‘এলাকার অসহায় হিন্দু-মুসলিম সবাই ডা. মঈন উদ্দিনের কাছ থেকে বিনামূল্যে সেবা পেয়েছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এসে তিনি এলাকার রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। বিনা ফিতে দেখা দরিদ্র রোগীদের কোম্পানি প্রদত্ত ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এখন এই মানুষগুলো কার কাছ থেকে এমন চিকিৎসাসেবা পাবে?’
নাদামপুর গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, ‘ডা. মঈন উদ্দিন শুধু গরিবের ডাক্তার ছিলেন না। এলাকার কোনো রোগী সিলেট নগরের সোবহানীঘাটে তার চেম্বারে গেলে তিনি তাদেরও ফ্রি চিকিৎসা দিতেন। মানুষের সঙ্গে এমন ভালো ব্যবহার করতেন যাতে রোগীর রোগ অর্ধেক কমে যেত। মানুষের সেবা করতে গিয়েই গেলেন। এমন মানুষের মৃত্যু নেই। তার কর্মেই তিনি বেঁচে থাকবেন।
এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সিলেটের চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিনের পরিবারের দায়িত্ব সরকার নেবে এবং একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিশেষ বীমার ভাতা খুব দ্রুত তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
প্রসঙ্গত, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সিলেটে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হন ডা. মঈন। গত ৫ এপ্রিল আইইডিসিআর থেকে তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। গত ৩০ মার্চ থেকে তিনি তার বাসায় কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ৭ এপ্রিল সিলেট নগরের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। ৮ এপ্রিল পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালেই তার চিকিৎসা চলছিল।
সোমবার সকাল থেকে তাকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) নেয়া হয়। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় বুধবার সকালে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ছামির মাহমুদ/এফএ/পিআর