ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দিনাজপুরের চড়ারহাটের গণহত্যা ট্রাজেটি দিবস আজ

প্রকাশিত: ০১:৪৬ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০১৫

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার মহাসড়ক সংলগ্ন প্রাণকৃঞ্চপুর (চড়ারহাট) ও আন্দলগ্রাম (সারাইপাড়া) পাশাপাশি সবুজ শ্যামল ছায়া সুনিবিড় শান্ত দুটি গ্রাম। এই গ্রাম দুটিকে ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ভোরবেলা অশান্ত করে তুলেছিল।

তখন মসজিদে ফজরের আযান দিচ্ছেন মোয়াজ্জিম। ঘুম ভাঙা চোখে গ্রামবাসীর প্রথম দৃষ্টি পড়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উপর। শত শত হানাদার গোটা গ্রাম ঘেরাও করে মেশিনগান এসএমজি তাক করে রাখলে গ্রামবাসীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও পালিয়ে যাবার কোনো পথ ছিল না। প্রাণে বাঁচার শেষ আশ্রয় হিসেবে প্রায় সবাই ছুটে যান গ্রামের একমাত্র মসজিদে।

অন্যদিকে, একদল পাকহানাদার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর ও মহিলাদের ধরে এনে গ্রামের উত্তর পূর্ব কোনের মাঠে সমবেত করে। পাকবাহিনী রাস্তায় মাটি কাটার কথা বলে মসজিদের লোকজনকে একই স্থানে নিয়ে আসে। এরপর নির্দেশ দেয় সবাইকে কলেমা পড়ার।

আতঙ্কিত গ্রামবাসী কলেমা পড়ার সাথে সাথে তাদের উপর শুরু হয় মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার। ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে এক সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিরীহ বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর ও মহিলারা।

এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞে প্রাণকৃঞ্চপুর (চড়ারহাট) ৫৭ জন, আন্দলগ্রাম (সারাইপাড়া) ৩১ জন, বেড়ামলিয়া ১ জন, আহম্মদ নগর ৩ জন, নওদা পাড়া ১ জন, শিবরামপুর ১ জন, চৌঘরিয়া ১ জন, আমতলার ১ জন, দুইজন মহিলাসহ নাম ও ঠিকানাবিহীন অনেক নিরীহ মানুষ সেদিন শহীদ হন।

এসব শহীদের মধ্যে ৯৮ জনের লাশ সনাক্ত করা যায়। বাকি লাশগুলো সনাক্তকরণ ছাড়াই দাফন করা হয়। তাদের ভাগ্যে জোটেনি এক টুকরো কাফনের কাপড়ও। শুধু মশারি, কাঁথা ও শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে একই কবরে ৪-৫টি করে লাশ দাফন করা হয়। এখন আর সেই গণকবরগুলোর কোনো অস্থিত্ব নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা বিলিন হয়ে গেছে। ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে গণ কবরগুলো।

ওই দিন হানাদারদের কাছ থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ডা. এহিয়া মন্ডল, আঃ হামিদ, মোজাম্মেল হক মাস্টার, ডা. আবুল কালাম, আঃ রশিদসহ ১১ জন এখনও সেই ভয়াল নারকীয়তার স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছেন।

সরকারিভাবে স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না হওয়ায় ৪০ বছরের মাথায় পার্শ্ববর্তী হাকিমপুর থানার মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার রায় নিজের বসতবাড়ি বিক্রি করে চড়ারহাটের বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তার এই মহানুভবতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সে সময়ের নবাবগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমান এমপি শিবলী সাদিক, বিরামপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল আলম রাজু, হাকিমপুর উপজেলাে সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, ঘোড়াঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান কাজী শুভ রহমান ও চড়ারহাটের বিশিষ্ট ডা. আবুল কালাম ইট, সিমেন্ট ও অর্থ দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে এগিয়ে আসেন।

কৃষক নওশের আলী মন্ডলের দানকৃত জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে চড়ারহাট শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।

এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোক্তা মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার রায় এক বছর পরেই মারা যান। তিনি তার মরহেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করে যান।

ওই সময়ের টকবগে যুবক আজকের বৃদ্ধ হাসান আলী (৭০) এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি পেশায় একজন কাপড় ব্যবসায়ী। চড়ারহাট গণহত্যার বিষয়ে কথা বলতে গেলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজী হননি। পরে নিজের রাগ অভিমানের কথা বলেই হড়হড় করে বলতে শুরু করে দিলেন সেই দিনের কথা। বললেন ভাগ্যচক্রে নিজের বেঁচে যাওয়ার কথা। বললেন হতাশার কথা।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, সেই সস্বাধীনতার পর থেকেই তো বলে আসছি। কই কিছু তো হয়না। যে টুকু হয়েছে তা তো কেবল ব্যক্তি প্রচেষ্টায়। সরকার তো কিছুই করলোনা। নিহত ও আহত পরিবারগুলো এখনো পর্যন্ত পায়নি কোনো মর্যাদা বা সহায়তা। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে গণ কবরগুলো। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্দ্যোগে দিবসটি পালনের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ভোরে হানাদারদের হাত থেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ডা. এহিয়া মন্ডল (৭৬) জানান, সরকার এ গণহত্যায় নিহতদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃৃতি প্রদান ও যথাযথ পূনর্বাসন করা, আহতদের যুদ্ধাহত হিসেবে স্বীকৃৃতি প্রদান করা এবং অত্র এলাকায় শহীদদের স্মরণে চড়ারহাটে শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার জোর দাবি জানায়।

যে কারণে এই হত্যাযজ্ঞ : ৭১ এর ৩ অক্টেবর চড়ার হাটের পথ ধরে গরুর গাড়িতে করে ৮ জন পাকসেনা বিরামপুরের দিকে আসার পথে বিরামপুর থানার বিজুল ও দিওড় গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে মুক্তিবাহিনী ৭ জন পাকসেনাকে হত্যা করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ১ জন পালিয়ে গিয়ে পাক সেনাদের ক্যাম্পে খবর দিলে পাক সেনারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

পালিয়ে যাওয়া ওই পাকসেনার ভুল নিশানার কারণে দিওড় গ্রামের পরিবর্তে আন্দোলগ্রাম-চড়ারহাট গ্রাম দুটিতে পাক হানাদাররা গণহত্যা চালিয়ে ১৫৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। চড়ারহাটের গণকবরটির সীমানা বেষ্টনি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেই হত্যাযজ্ঞের দু’মাস পর দেশ স্বাধীন হয়।

শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে এলাকাবাসী চড়ারহাটে শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় ও শহীদ স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে।

এমএএস/আরআইপি