পল্লীফোন থেকে ফ্লেক্সিলোড যুগের করিমুন নেছা
সুনামগঞ্জে বেশ পরিচিত একটি মুখ করিমুন নেছা। ২০০৩ সাল থেকে পল্লীফোনের ব্যবসা করে আজ তিনি একজন সফল নারী। সুনামগঞ্জে তিনিই প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন। বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই নিজের ভাগ্য লিখেছেন। ১৭ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসা।
সরজমিনে সুনামগঞ্জ পৌরশহরের ঘোলঘর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, করিমুন পল্লীফোন সেন্টার নামে একটি দোকান রয়েছে। একসময় ১০ টাকা মিনিটে মানুষের যোগাযোগ করে দেয়া করিমুন নেছা বর্তমানে একজন সংরক্ষিত ইউপি সদস্য। মেম্বার হয়েও ছাড়েননি নিজের প্রথম ব্যবসা। বিয়ে হলেও এখন আর স্বামীর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। জীবনের শুরুটা যেখানে শেষটাও ঠিক সেখানেই চান সন্তানহীন এই মানুষটি।
করিমুন নেছার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ১৯৮৯ সালে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছুদিন সেলাই কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে গণশিক্ষার মাধ্যমে নারী উন্নয়নের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজও করেন তিনি। সেই সময় ২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে নিজের ব্যক্তিগত খরচ শেষ যা অবশিষ্ট থাকতো তা জমিয়ে ২০০৩ সালে শুরু করেন পল্লীফোনের ব্যবসা। তখনকার সময়ে মানুষ লাইন ধরে তার গ্রামীন ফোন থেকে পাওয়া পল্লীফোনে কথা বলত ৮-১০ টাকা মিনিটে। যুগের পরবর্তীতে মানুষের হাতের নাগালে মোবাইল ফোন চলে আসায় ব্যবসায় ক্ষতি হতে থাকে তার। পরবর্তীতে মোবাইলে কার্ডের মাধ্যমে রিচার্জ এবং বর্তমানে ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশ এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
বাবা-মা কোনো সময় ছিলেন না তার পক্ষে। বাহিরের লোক কী বলবে সে কারণে মেয়েকে ব্যবসা করার অনুমতি দেননি তারা। তবে একসময় সবার ভুলই ভেঙেছে।
বর্তমানে নিজের ইউনিয়ন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবান নগর ইউনিয়নে মহিলা সংরক্ষিত মেম্বার হয়ে ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের কাজ করছেন সুনামের সঙ্গে। সৎ পথে থাকার একটি শপথ নিয়ে কাজ শুরু করা করিমুন নেছার বর্তমানে অভাব অনটন নেই বললেই চলে।
জাগো নিউজকে করিমুন নেছা বলেন, আমার স্বপ্ন ছিলো সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার। অনেকবার অনেক সরকারি কার্যালয়ে ইন্টারভিউ দিলেও চাকরি হয়নি। পরে আমি কাজ করেছি গণশিক্ষায় মাঠকর্মী হিসেবে। সেখান থেকে যে টাকাটা পেতাম সেটার কিছু অংশ জমিয়ে শুরু করি পল্লীফোনের ব্যবসা। সুনামগঞ্জের মধ্যে আমিই প্রথম সেই ব্যবসার করি।
এমন পেশায় আসার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি সেই সময় দেখতাম মানুষের মধ্যে যোগাযোগের কোনো সহজ ব্যবস্থা ছিলো না। তাদের সিলেট গিয়ে কথা বলতে হতো। তাই ভাবলাম যদি এই ব্যবসা শুরু করি তাহলে মানুষের উপকার হবে এবং আমিও কিছু টাকা আয় করে সংসার চালাতে পারবো। সেই থেকে আমার যাত্রা শুরু। এখনও আছি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ করিমুন পল্লীফোন ব্যবসাটি থাকবে।
করিমুন নেছা ২০০৫ সালে আচার-আচরণ ও আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে নিজের এবং কেন্দ্রের সামাজিক উন্নয়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংক বোদওয়াঁ পুরস্কার। তাছাড়া বর্তমানে নারী উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়মূলক কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি।
সমাজে যে অসমতা রয়েছে তার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একজন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বামের বেতন অনেক টাকা। কিন্তু আমরা সংরক্ষিত আসনের মেম্বাররা তার থেকে অনেক কম পাই। অথচ আমাদের একসাথে ৩টি ওয়ার্ড দেখতে হয়। আর পুরুষদের থাকে প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে। এখানে নারীদের কাজের চাপ বেশি হলেও সম্মানী কিন্তু দেয়া হচ্ছে ওয়ার্ড মেম্বার থেকে কম। তাই সরকারের উচিত সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতা প্রদান করা।
করিমুন নেছা বলেন, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি। ব্যবসার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখে এক হয়ে কাজ করছি। আমার ইউনিয়নের মানুষের উন্নয়নে কাজ করছি, বিশেষ করে নারীদের স্বাধীনতা ও অধিকার বিষয়ে আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ছেলে-মেয়ে নেই, তো কী হয়েছে? এই যে আমি যাদের নিয়ে কাজ করছি তারাও আমার ছেলে-মেয়ে।
এফএ/পিআর