প্রতি মাসে বেতনের টাকায় শিক্ষার্থীদের উপহার দেন ইউএনও
তাকে দেখলেই আনন্দে মন ভরে যায় খুদে শিক্ষার্থীদের। কোনো কোনো শিক্ষার্থী দৌড়ে তার কাছে ছুটে আসে। পরম মমতায় এসব খুদে শিক্ষার্থীকে কাছে টেনে নেন, কখনও আদর করে দেন তিনি। সেই সঙ্গে এসব শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেন বিভিন্ন ধরনের উপহার। এতে আনন্দে আত্মহারা খুদে শিক্ষার্থীরা।
এসব খুদে শিক্ষার্থীর এমনই একজন প্রিয় মানুষ ‘রুমা ম্যাডাম’। ম্যাডাম ডাকলেও তার কাছ থেকে মায়ের মতো আদর-সোহাগ পায় খুদে শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে পায় নানা উপহার। তাদের প্রিয় রুমা ম্যাডাম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কর্মরত। বেতনের টাকায় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের উপহার কিনে দেন তিনি।
শিক্ষার্থীর হাতে স্কুলব্যাগ ও ছাতা তুলে দিচ্ছেন ইউএনও রুমা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে এবং শিক্ষার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ব্যতিক্রমী কাজ করছেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী ও পড়াশোনায় মনোযোগী করতে নানা ধরনের উপহার দেন তিনি। প্রতি মাসে নিজের বেতনের টাকায় সদর উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন স্কুলব্যাগ, স্কুলড্রেস, খাতা-কলম, ছাতা, রঙ পেন্সিল, ডায়েরি, টুথ ব্রাশ, নেইল কাটার ও চকলেট।
এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের পুরান লক্ষ্মণশ্রী গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে যান ইয়াসমিন নাহার রুমা। এ সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে স্কুলব্যাগ, খাতা-কলম, রঙ পেন্সিল, ডায়েরি, টুথব্রাশ, নেইল কাটার এবং চকলেট তুলে দেন তিনি। ইউএনওর কাছ থেকে এসব উপহার পেয়ে আনন্দে আত্মহারা খুদে শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে প্রিয় রুমা ম্যাডামকে ধন্যবাদ দেয়ার পাশাপাশি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে বলে জানিয়েছে তারা।
খুদে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইউএনও রুমা
স্থানীয় সূত্র জানায়, হাওরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে দুর্বল। অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ফেল করে। বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব চালু করেন ইউএনও ইয়াসমিন নাহার রুমা। এতে বিনে পয়সায় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়ানো হয়। ইউএনওর তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালিত হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ইংরেজিভীতি দূরীকরণে দারুণ সহায়তা করছে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব।
লক্ষ্মণশ্রী গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান তালুকদার বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে ইউএনও রুমা যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগ এর আগে আমি দেখিনি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে ইউএনও রুমার মতো সবাই যদি এগিয়ে আসে তাহলে সুনামগঞ্জে যেসব অবহেলিত বিদ্যালয় রয়েছে সেগুলোর শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করবে। সেই সঙ্গে সুনামগঞ্জে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার্থীদের হাতে স্কুলব্যাগ তুলে দেন ইউএনও
এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াসমিন নাহার রুমা বলেন, সুনামগঞ্জে আসার পর থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের পরিকল্পনা ছিল আমার। আমি চাই হাওরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হোক। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাক। কারণ পড়াশোনার বিকল্প নেই। আমি সুনামগঞ্জে এসে সবার আগে দেখতে পাই এখানের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিকে ভয় পায়। অনেকেই ইংরেজি বিষয়ে ফেল করে। এজন্য প্রথমেই নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব চালু করি। এটিতে বিনে পয়সায় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়ানো হয়। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রতি শুক্রবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বিষয় পড়ানো হয়। সেই সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলা শেখানো হয়।
ইউএনও রুমা বলেন, আমার প্রথম কাজ সুনামগঞ্জের অবহেলিত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শতভাগ নিশ্চিত করা। কারণ বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থী নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এজন্য বেতনের টাকায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের উপহার দিয়ে বিদ্যালয়মুখী হওয়ার চেষ্টা করছি। এটি অব্যাহত থাকবে।
শিক্ষার্থীদের হাতে স্কুলব্যাগ তুলে দেন ইউএনও
তিনি আরও বলেন, খুদে শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ছাড়া সুশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের নেইল কাটার, টুথপেস্ট ও টুথব্রাশজাতীয় উপহার দেয়া হয়। এতে ছোট থেকেই একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে তারা। পাশাপাশি প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হওয়া শিক্ষার্থীকে পুরস্কার হিসেবে স্কুলব্যাগ, ড্রেস, খাতা-কলম ও রঙ পেন্সিল দেই। এছাড়া প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে ডায়েরি দেয়া হয়।
ইউএনও রুমা বলেন, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থেকে এসব কাজ করছি আমি। তবে এটা শুধু আমার একার কাজ নয়। আমি চাই সুনামগঞ্জের সবাই শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করুক। এজন্য যদি কোনো সহায়তা প্রয়োজন হয় অবশ্যই করব।
এএম/পিআর