ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

দালালের ভয়ে জুনেদের মরদেহ দেশে আনতে পারছে না পরিবার

মোসাইদ রাহাত | সুনামগঞ্জ | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

পরিবারের হাল ধরতে দালালের মাধ্যমে স্পেনে যেতে চেয়েছিলেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার আলাউদ্দিনের ছেলে আমির হোসেন জুনেদ। কিন্তু জীবন্ত না যেতে পারলেও স্পেনে গেছে তার মরদেহ। বর্তমানে তার মরদেহ দেশে আনতে চাইলেও দালালের ভয়ে পারছে না পরিবার। ছেলের মরদেহ ও ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর টাকা যেনো আর না চাওয়া হয় সেজন্য তার পরিবারকে নানা রকম চাপ ও হুমকি দেয়া হচ্ছে।

জুনেদের পরিবারের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সুনামগঞ্জ শহরের বাধনপাড়া আবাসিক এলাকার মাওলানা আনোয়ার হোসেন, তার ছেলে মাওলানা হোসাইন আহমদ, হোসাইন আহমদের ভগ্নিপতি সিরাজ মিলে আমির হোসেন জুনেদকে স্পেনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। জুনেদের বাবা আলাউদ্দিন প্রথমে মাওলানা হোসেনকে ৬ লাখ টাকা দেন। তার বোন খালেদার অ্যাকাউন্টেও টাকা পাঠান। খালেদার স্বামী সিরাজ বাইরের দালালদের সঙ্গে সমন্বয় রাখেন। শুরু থেকেই পরিবারের লোকজন মাওলানা আনোয়ার, তার ছেলে হোসেন ও জামাই সিরাজের সঙ্গে জুনেদের বিষয়ে কথা বলেন। এদের মাধ্যমেই জুনেদ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান বিদেশের উদ্দেশ্যে।

চুক্তি অনুযায়ী হোসেন ও সিরাজ মিলে প্রথমে জুনেদকে দুবাই পাঠান। প্রায় ৬ মাসেরও অধিক জুনেদ দুবাই অবস্থান করেন। তাকে দালালরা বন্দিশালায় রেখে নির্যাতন করে। তবে এই সময় হোসেন ও সিরাজের মাধ্যমে খবর নিতেন পরিবারের লোকজন। মাঝে-মধ্যে দালালরা জুনেদের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিত। তবে দুবাই থেকে অবৈধভাবে সাগরপথে মরোক্ক পাঠানো হয় জুনেদকে। তখন জাহাজে তুলে আরও টাকা পাঠানোর জন্য জুনেদেকে নির্যাতন করে দালালরা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিত দালালরা।

এ সময় পরিবারের লোকজন আনোয়ার, হোসেন ও সিরাজের সঙ্গে কথা বলে সিরাজের স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠান। এভাবে দফায় দফায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন জুনেদের বাবা আলাউদ্দিন। কিন্তু দুবাই থেকে মরোক্ক হয়ে স্পেন যাওয়ার পর দীর্ঘদিন জুনেদের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি স্বজনরা। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত দুইবার কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ দেয় দালালরা। তবে টাকা পাঠানোর জন্য নির্যাতন করে জুনেদের কান্না শুনাতো দালালরা।

স্পেনের যাওয়ার সময় ২৬ নভেম্বর ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে ৭৯ জনকে উদ্ধার করে উদ্ধার কর্মীরা। এর মধ্যে জুনেদসহ ১৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। জুনেদকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয় স্পেনের দৈনিক ‘এলপাইস’ পত্রিকাসহ সেদেশের বিভিন্ন অনলাইনে। তার পরিচয় উদ্ধার করে স্পেনের বাংলাদেশ দূতাবাস জুনেদের মৃত্যুর খবর পরিবারকে অবগত করে এবং সরকারিভাবে মরদেহ নিতে আহ্বান জানায়। গত ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও মিশন উপ-প্রধান এম হারুন আল রাশিদ ম্যালিয়ায় গিয়ে জুনেদের মরদেহ শনাক্ত করেন। পরে দূাতাবাসের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকারি খরচে মরদেহ আনার কথা জানানো হয়।

কিন্তু জুনেদের মৃত্যুর পর দালালরা জুনেদের পরিবারকে বুঝাতে সক্ষম হয় মৃত সন্তানকে আর পাওয়া যাবে না। মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে টাকা আদায়ের জন্য প্ররোচনা দেয়া হয়। এমনকি ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরও স্বজনরা দালালের কথায় বিশ্বাস করে এখন পর্যন্ত মামলা মোকদ্দমা থেকে বিরত রয়েছেন বলে জানা গেছে। এই দালালরাই জুনেদের মরদেহ আনতে নিষেধ করছে তার পরিবারকে।

সুনামগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন ইন কাতালোনিয়ার সভাপতি মনোয়ার পাশা বলেন, জুনেদের মরদেহ শনাক্ত হওয়ার পর তার তথ্য সংগ্রহ করে আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দূতাবাসকে তথ্য দিয়েছি। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি দালালরা জুনেদের পরিবারবে মরদেহ না নিতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।

জুনেদের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, আমি সুদে ধারদেনা করে আনোয়ার ও তার ছেলে হোসাইনের হাতে প্রথমে ছয় লাখ টাকা দিয়েছি। পরে বিদেশে নেয়ার পর আমার ছেলেকে নির্যাতনের খবর পেয়ে হোসাইনের বোন খালেদা ও তার স্বামী সিরাজকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। এভাবে কয়েক দফায় ১৮ লাখ টাকা দিয়েছি। আমার ছেলেটাকে আর ফিরে পাব না। এখন নিঃস্ব হয়ে আমি টাকা ফেরত চাইছি, কিন্তু দালাল আনোয়ার, হোসাইন ও জুনেদ বারবার দিন দিচ্ছে কিন্তু টাকা দিচ্ছে না। তারা আমার ছেলের মরদেহও আনতে দিচ্ছে না, টাকাও দিচ্ছে না।

জুনেদের চাচা জালাল উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা যেহেতু জুনেদকে আর ফিরে পাব না তাই মরদেহ আনার চিন্তা বাদ দিয়েছি। জুনেদের বাবা ঋণ করে ১৮ লাখ টাকা দিয়েছে। আমরা সেই টাকা ফেরত চেয়েছি। একাধিকবার তারিখ ও ঘরোয়া বৈঠক করেও আনোয়ার, হোসাইন ও সিরাজ টাকা দিচ্ছে না। এরা সবাই মিলে স্পেনে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে। এদের বিচার চাই আমরা।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।

আরএআর/এমএস