গাভি পালন করে মাসে লাখ টাকার দুধ বিক্রি
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জেয়ালা গ্রামে ঘোষ সম্প্রদায়ের বসতি। এক সময়ের অবহেলিত ঘোষপাড়া জনপদটি এখন দুগ্ধপল্লী নামে পরিচিত। প্রতিদিন ৩০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয় এই পল্লীতে। এসব দুধ পাঠানো হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। যা প্রভাব ফেলেছে এলাকার অর্থনীতিতেও। এলাকার তরুণ-যুবকরাও এখন ঝুঁকছে গাভি পালনে, গড়ে তুলছেন খামার।
২০১০ সালে উপজেলার আটারই গ্রামের আবু হারেজ সরদারের ছেলে আল-আমিন সরদার দুটি গাভি নিয়ে খামার শুরু করেন। এখন আল-আমিনের খামারে ৩০টি গাভি। দৈনিক খরচ বাদ দিয়েও দুধ বিক্রি করে আয় করছেন ১০০০-১২০০ টাকা।
খামারি আল-আমিন সরদার বলেন, এক সময় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। একটি গাভি ৫৫ হাজার ও আরেকটি ৮৫ হাজার টাকায় কিনে পালন শুরু করি। এখন আমার খামারে রয়েছে ৩০টি গাভি। এর মধ্যে ১০টি গাভি দৈনিক একশ লিটার দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৩৫ টাকায়। আমার খামার থেকে দৈনিক ৩৫শ টাকার দুধ বিক্রি হচ্ছে। বাকি গাভিগুলোও পর্যায়ক্রমে দুধ দেবে। বর্তমানে ৩ হাজার ৫০০ টাকার দুধ বিক্রি করে গাভির পেছনে খরচ বাদ দিয়ে ১০০০-১২০০ টাকা লাভ হচ্ছে। অভাব কাটিয়ে আমি এখন স্বাবলম্বী।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা দুধ বিক্রি করি ঘোষ সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের কাছে। দুধের প্রকৃত মূল্য আমরা পাই না। মধ্যস্বত্বভোগীরাই বেশি লাভবান হয়। খুলনা, বরিশাল ও ঢাকায় প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৬০-৮০ টাকায়। অথচ আমরা পাচ্ছি মাত্র ৩২ টাকা। বিভিন্ন সময় সভা সেমিনারে এসব অভিযোগের কথা জানালেও আশ্বাস দিয়েও কোনো সুরহা হয়নি। দুধ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের আছে আমাদের মতো খামারিরা অসহায়। কিছুই করার থাকে না।
তালা দুগ্ধ কেন্দ্র সমিতির সভাপতি দিবস চন্দ্র ঘোষ জেয়ালা গ্রামের ঘোষপাড়ার বাসিন্দা। তার খামারে দৈনিক ৩শ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। তিনি খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করছেন।
দিবস চন্দ্র ঘোষ বলেন, বাবা দুধের ব্যবসা করতেন। এটা আমাদের পৈতৃক ব্যবসা। তবে আগে স্বল্প পরিসরে থাকলেও বর্তমানে খামারটি বড় আকারে করেছি। আমার ২৩টি গাভির মধ্যে দৈনিক ২১টি গাভি ৩০০ লিটার দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৩৭.৫০ টাকা। যা বিক্রি হয় ১১ হাজার টাকা। এছাড়া দৈনিক খরচ হয় ৬-৭ হাজার টাকা। প্রতিদিন খরচ বাদ দিয়েও ৫ হাজার টাকার অধিক লাভ হয়।
তিনি বলেন, জেয়ালা ঘোষপাড়ায় রয়েছে ১২০ জন খামারি। এছাড়া জেয়ালা গ্রামের মধ্যে রয়েছে আরও তিনশ খামারি। এলাকার বেকার যুবকরাও এখন গাভি পালন ও খামার করেছেন। জেয়ালা ঘোষপাড়া থেকে দৈনিক ২০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এসব দুধ মিল্ক ভিটার কাছে বিক্রি করা হয়। শুধুমাত্র ঘোষপাড়া থেকে দৈনিক সাড়ে ৭ লাখ টাকার দুধ বিক্রি হয়। যা প্রভাব ফেলেছে এলাকার অর্থনীতিতেও। এছাড়া ঘোষপাড়ার বাইরেও তালার বিভিন্ন এলাকার খামারিদের কাছ থেকে আরও ১০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। দুধ উৎপাদনই বদলে দিয়েছে অবহেলিত ঘোষপাড়াকে।
জেয়ালা ঘোষপাড়ায় পশু চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়ে তালা দুগ্ধ কেন্দ্র সমিতির সভাপতি দিবস চন্দ্র ঘোষ বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর আমাদের সহযোগিতা করেন। তবে চিকিৎসা কেন্দ্র দূরবর্তী হওয়ায় খামারিদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দুগ্ধপল্লী খ্যাত জেয়ালা ঘোষপাড়ায় সরকারিভাবে যদি একটা পশু চিকিৎসা ক্যাম্প করা হয় তবে খামারিদের দুর্ভোগ দূর হবে। এছাড়াও গোখাদ্য যদি সরকার ভর্তুকির মাধ্যমে অল্প দামে দেয়ার ব্যবস্থা করে তবে খামারিরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে বেকার যুবকরা আরও গাভি পালনে উদ্বুদ্ধ হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা জেলা গরুর দুধে সমৃদ্ধ। জেলায় প্রতি বছর ১.৯০ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় তালা উপজেলায়। তালার দুগ্ধপল্লী জেয়ালায় উৎপাদন হয় সব থেকে বেশি। চাহিদার চেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হওয়ায় এসব দুধ পাঠানো হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রাণ, ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্ক ভিটা প্রভৃতি কোম্পানি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে।
তিনি বলেন, জেলায় খামারির সংখ্যা রয়েছে ২ হাজার ৫০২ জন। ছোট বড় খামার রয়েছে ২ হাজার ৫০২টি। খামারিদের প্রযুক্তিগত সাপোর্ট দেয়া হয়। এছাড়া চিকিৎসা-সংক্রান্ত সহায়তা ও খামারিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গাভি পালনের পরামর্শ দেয়া হয়।
খামারিদের দাবির বিষয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) লাইভ স্টক অ্যান্ড ডেভোলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি মেগা প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিরা রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন। রেজিস্ট্রেশন করার পর খামারিরা তাদের ইচ্ছামতো দুধ বিক্রি করতে পারবেন। আমরা তাদের মার্কেটিং ও উৎপাদনে সহযোগিতা করবো। এছাড়াও সরকারিভাবে আর্থিকসহ আনুসাঙ্গিক সহযোগিতাও করা হবে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর/এমকেএইচ