মৌসুমের শুরুতে রাঙামাটিতে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভিড়
সদ্য বর্ষা শেষে শুরু হয়েছে পর্যটন মৌসুম। আর এরই মধ্যে প্রকৃতির নিসর্গ পার্বত্য রূপনগর রাঙামাটিতে পর্যটকদের আগমন শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পর্যটন কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে দৃষ্টিনন্দিত মনোরম ঝুলন্ত সেতুটি কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে থাকলেও তা পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এবার কুরবানি ঈদ অবকাশে বিপুল সংখ্যক পর্যটক রাঙামাটি এসেছেন। ঈদের পরদিন থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাঙামাটি পর্যটন মোটেলসহ শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতে পর্যটকদের ভিড় ছিল। এর পর পরই সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার মোটেল, হোটেলগুলোর সব কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। মূলত ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই পর্যটকদের আগমন শুরু হয়। সেই থেকে আগে আসা পর্যটকরা রাঙামাটি ছাড়লেও পরে আসা পর্যটকদের ভিড়ে এখনও মুখরিত পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি।
রাঙামাটি পর্যটন মোটেল ও হলিডে কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা জাগো নিউজকে জানান, ঝুলন্ত সেতুটি পানিতে ডুবে থাকলেও তা পর্যটকদের ভ্রমণে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। ঈদে প্রচুর পর্যটক রাঙামাটি ভ্রমণে এসেছেন। এর পরপরই রাঙামাটি পর্যটন মোটেলে নতুন অতিথিদের ভিড়ে কক্ষগুলো আবারও ঠাসা। চলতি সপ্তাহজুড়ে বুকিং রয়েছে। ঝুলন্ত সেতুটি সবার কাছে দৃষ্টিনন্দিত।
তিনি বলেন, তবে বর্তমানে সেতুটি জলমগ্ন থাকলেও সুবলং ঝরণা, কাপ্তাই লেকে নৌ-ভ্রমণ, চাকমা রাজার বাড়ি, রাজবন বিহার, ডিসি বাংলো, টুকটুক ইকো ভিলেজসহ বিভিন্ন দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্পট ও স্থাপনাগুলোতে আগত পর্যটকরা পাড়ি দিচ্ছেন। ছুটছেন লেক, পাহাড়, ঝরণা দেখতে। বাঘাইছড়ির সাজেক ভ্যালি পর্যন্ত পাড়ি দিচ্ছেন পর্যটকরা।
তিনি আরো বলেন, বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পানি নামায় কাপ্তাই লেকের পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। এতে ঝুলন্ত সেতুটি তলিয়ে যায়। সেই থেকে প্রায় দু’মাস ধরে সেতুটি জলমগ্ন। তবে পর্যটন মৌসুম আসন্ন হওয়ায় পর্যটকদের আগমণ ক্রমে বাড়তে থাকবে। এছাড়া পানি কমে গেলে ঝুলন্ত সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
রাঙামাটি জেলাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য নৈসর্গিক আবেশ ও দর্শনীয় স্থান। সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে উঠেছে অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনা যা সহজেই মন কাড়ে ভ্রমণপিপাসু প্রকৃতিপ্রেমীদের।
সরকারি পর্যটন মোটেল ছাড়াও রয়েছে ডিসি বাংলো, পেদাটিংটিং, সুবলং ঝর্ণা ও পর্যটন স্পট, টুকটুক ইকো ভিলেজ, গিরিশোভা ভাসমান রেস্তোঁরা, পৌরপার্ক, সুখী নীলগঞ্জ, উপজাতীয় যাদুঘর, রাজবন বিহার, চাকমা রাজার বাড়ি, বীরশ্রেষ্ট মুন্সি আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধসহ মনোরম ও নয়নাভিরাম স্পট ও স্থাপনা সত্যিই যে কোন পর্যটককেই কাছে টানে। শিহরিত করে তোলে স্বচ্ছ কাপ্তাই হ্রদের জলে নৌ বিহারের মতো রোমাঞ্চকর নৌভ্রমণ।
এখানে রয়েছে এলামেলো সারিতে সাজানো উঁচু-নিচু ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ের সমাবেশ। যেদিকে চোখ যায় স্বচ্ছ পানি আর বিস্তীর্ণ সবুজের হাতছানি। দিগন্ত জোড়া বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা চোখ জুড়ানো ছবি। সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য পাহাড়ি ঝরনার কলতান আরও আকর্ষণীয় করেছে। তাই কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে সবাই ছুটছে নৈসর্গিক আবেশে অবসাদ দূর করতে পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটিতে।
সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, নৈসর্গিক আবেশ আর কাপ্তাই লেকের সমাবেশ ভ্রমণপিপাসুদের সত্যিই উদাস করে তুলেছে। ঈদের এ মৌসুমে পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটিতে তৈরি হয়েছে উৎসবের আমেজ। বেড়েছে পর্যটকদের ভিড়। এমনিতে প্রতি শুক্র ও শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের পদচারণায় কোলাহল জাগে পর্যটন স্পটগুলোতে। শিহরিত হয় পাহাড়ের প্রকৃতি। সবার মন কাড়ে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ জলধারা।
রাঙামাটি পর্যটন মোটেল ও হলিডে কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ঈদের প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই রাঙামাটিতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় জমছে। বর্তমানে পর্যটন মোটেল ও কটেজসহ রাঙামাটির আবাসিক হোটেলগুলো রয়েছে কানায় পূর্ণ। আয় বেড়েছে পর্যটন খাতে।
কেবল বাইরে থেকে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকরাই নন, স্থানীয়রাও ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে চলেছেন রাঙামাটির চোখ জুড়ানো প্রকৃতির সৌন্দর্যের আধারে। অনেকে কর্ম ব্যবস্ততার ফাঁকে পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে অবকাশ কাটাতে ছুটছেন বিভিন্ন মনোরম স্থানে। স্বচ্ছ জলাধারার আনন্দ উপভোগ করতে নৌভ্রমণে যাচ্ছেন মনোরম কাপ্তাই লেকে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। এর উত্তরে খাগড়াছড়ি জেলা, দক্ষিণে বান্দরবান, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য আর পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা। জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি কন্যা কর্ণফুলী নদী। মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। যার উৎপত্তি স্থল ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড়। কর্ণফুলী থেকে উৎপত্তি হয়েছে চেঙ্গী, মাইনি, কাচালং, সুবলং, রাইংখিয়ং, বরকল, হরিণা। এসব নদী মিলিয়ে গেছে কাপ্তাই লেকে।
রাঙামাটি জেলা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় ও উপভোগ্য স্থান। গড়ে উঠেছে অনেক দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। রাঙামাটির মূল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হলিডে কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে দৃষ্টিকাড়া ঝুলন্ত ব্রিজ, কটেজ ও মোটেল। কাপ্তাই লেকে নৌভ্রমণের জন্য রয়েছে স্পিডবোট, প্যাডলবোট ও ইঞ্জিনবোটের সুবিধা।
শহর থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে বালুখালীতে গড়ে উঠেছে সরকারি কৃষি বিভাগের কৃষিফার্ম, বেসরকারি পর্যটন স্পট টুকটুক ইকোভিলেজ, পেদাটিংটিং ও চাংপাং রেষ্টুরেন্ট। প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার নদীপথ দূরত্বে জেলার বরকল উপজেলার সুবলংয়ে মনোরম সুবলং ঝরনা স্পট। শহরের উত্তরে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাটে স্থাপিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ট মুন্সী আবদুর রউফের স্মৃতিসৌধ। এ সকল মনোরম স্পট ও স্থানে যেতে হলে রিজার্ভ করে নিতে হবে স্পিডবোট অথবা ইঞ্জিনবোট।
জেলা সদরেই রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের উভয়পাশে সাপছড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এবং পর্যটন স্পট ইজর। মূল শহরে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের প্রধান বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাজবন বিহার। পাশে কাপ্তাই লেক পরিবেষ্টিত বিচ্ছিন্ন রাজদ্বীপে অবস্থিত চাকমা রাজার বাড়ী। কাপ্তাই লেক ঘেঁষে শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মনোরম ডিসি বাংলো। এছাড়া বরকল, হরিণা, ঠেগামুখ সীমান্ত, মাইনী, কাচালং, সাজেক ভেলিতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বহু স্থান।
রাঙামাটির প্রবেশমুখে কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়ায় রয়েছে ঠান্ডাছড়ি চা বাগান এবং উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র। কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজ কল কেপিএম, কাপ্তাই বাঁধ, জাতীয় উদ্যান, নেভীক্যাম্প, জুম প্যানোরমা স্পট, শিলছড়ি বনানী পর্যটন স্পট, চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার, ওয়াগ্গাচা বাগানসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান।
রাঙামাটি যেতে হলে ঢাকা থেকে সরাসরি বিলাসবহুল বাস সার্ভিস এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী, ডলফিনসহ রয়েছে বিভিন্ন পরিবহন সুবিধা। ভাড়া বর্তমানে ছয়শ বিশ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম হয়ে রাঙামাটি যাওয়া যায় সরাসরি। বাসের ভাড়া ১২০ টাকা। থাকার জন্য সরকারি রেস্ট হাউজ, পর্যটন মোটেল, কটেজসহ শহরের রিজার্ভবাজার, বনরূপাসহ বিভিন্ন জায়গায় উন্নতমানের আবাসিক হোটেলের বন্দোবস্ত রয়েছে।
এসএস/এমএস