বঙ্গবন্ধুর স্বজনের নামও রাজাকারের তালিকায়
বঙ্গবন্ধুর স্বজন ও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত শহীদ সেরনিয়াবাতের বাবা আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের নাম রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায়। স্বজনদের দাবি ১৯৭১ সালে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত। ১৯৭১ সালে তখন তার বয়স ষাটের ওপরে। স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন দেশের।
দৃঢ় মনোবল আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বয়সের বাধা অতিক্রম করেছিলেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত। এলাকার যুবক, তরুণসহ নানা বয়সী মানুষকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্র দেওয়া, খাদ্য সরবরাহসহ বহু কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত।
এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে দাফতরিক বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা এই মানুষটির নাম রাজাকারের তালিকায় প্রকাশিত হওয়ায় বিস্মিত তার সন্তান ও স্বজনরা। তারা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতবাক। তার গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়া উপজেলার সেরালে বইছে নিন্দার ঝড়।
অবিলম্বে এ তালিকা সংশোধন করে ওই পরিবারের সম্মান রক্ষার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।
আগৈলঝাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফুপুর সঙ্গে আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের বাবা আব্দুল খালেক সেরনিয়াবাতের বিয়ে হয়। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই ছিলেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগমের সঙ্গে আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের ছোট ভাই শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বিয়ে হয়। সেদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বেয়াই হন তিনি। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত সরকারি চাকরি করতেন। নীতি-আদর্শ-রাজনীতির প্রশ্নে দৃঢ়চেতা এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত অনুসরণ করতেন বঙ্গবন্ধুকে। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের পর তিনি পাকিস্তান সরকারের চাকরি ছেড়ে দেন। ওই সময় আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত পরিবার নিয়ে নগরীর কালী বাড়ি রোডের বাসায় থাকতেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় তার ৬ ছেলের মধ্যে ৪ ছেলে কিশোর বয়স পেরিয়ে ছিল। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্ততি নেয়ার নির্দেশ দেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে নগরীর বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে যান গ্রামের বাড়ি আগৈলঝাড়ার সেরালে।
সেখানে গিয়ে যুবক, তরুণসহ নানা বয়সী মানুষকে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য তার উদ্যোগে গ্রামের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এসব কারণে স্থানীয় রাজাকারদের নজরে পড়ে যান তিনি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একদিন তার গ্রামে বাড়িতে পাক সেনারা হানা দেয়।
তাদের বাড়িসহ আরও কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। সেই যাত্রায় পালিয়ে রক্ষা পান তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। সেই যে ঘর ছেড়েছিলেন, ৮ ডিসেম্বর বরিশাল পাক হানাদারমুক্ত হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে বসবাস করা হয়নি তার।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, তার একটি দোনালা বন্দুক ছিল। বাড়ি ছাড়ার সময় বন্দুকটি সঙ্গে নিয়ে ছিলেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত। এপ্রিলের শেষ দিকে উপজেলার রত্নপুর ইউনিয়নের কাজী বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, খাদ্য সরবরাহসহ প্রভৃতি কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত।
বিপদ জেনেও অসীম সাহসিকতায় দেশমাতৃকার জন্য বরিশাল পাক হানাদারমুক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন তিনি।
রইচ সেরনিয়াবাত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যার ৪ সন্তান ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম আজ রাজাকারের তালিকায়। আমরা এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও হতবাক। অবিলম্বে এ তালিকা সংশোধন করে ওই পরিবারের সম্মান রক্ষা করা হোক। এই অসম্মানের জন্য তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।
আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের ছেলে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আমান সেরনিয়াবাত জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কর্মস্থলে সেনাবাহিনীর প্রধান আইয়ুব খান নিয়ে নানা সমালোচনা করতেন। ধিক্কার জানাতেন। এ কারণে ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে বাবাকে। তার দোনালা বন্দুকটি যুদ্ধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দেন। তার নির্দেশে আমরা ৪ ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিলাম। যুদ্ধের সময় বাবা বাড়ি থাকতে পারেননি। মাঝে মধ্যে গোপনে এসে দেখা করে যেতেন।
৪৯ বছর পর আজ সেই ইতিহাস উল্টে গেছে। বাবার নাম রাজাকারের তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এ ঘটনার আমরা নিন্দা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
আমান সেরনিয়াবাত জানান, ১৯৮৬ সালে বাবা মৃত্যুবরণ করেন। বাবা জীবিতকালে এ অবস্থার সম্মুখীন হলে তিনি হয়তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতেন না।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক বীর প্রতীক বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। আবদুল হাই সেরনিয়াবাত কোনোভাবেই দেশবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিলেন না। শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আব্দুল হাই সেরনিয়াবাত। অবিলম্বে এ তালিকা সংশোধন করে ওই পরিবারের সম্মান সুরক্ষা করা হোক। এই অসম্মানের জন্য তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।
সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকার বরিশাল অংশে ৫৮ নম্বর সিরিয়ালে নাম রয়েছে আবদুল হাই সেরনিয়াবাতের। আবদুল হাই সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সাবেক কৃষিমন্ত্রী প্রয়াত আবদুর রব সেরনিয়াবাতের একমাত্র বড় ভাই। আবদুর রব সেরনিয়াবাত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তিনি ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। আবদুর রব সেরনিয়াবাত ১৯৭৩ সালে বরিশাল থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
আবদুল হাই সেরনিয়াবাতের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সেরনিয়াবাত ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধসহ রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে সামনের সারির মানুষ ছিলেন। ১৯৭৪ সালে আইন পাশ করার পরপরই কোর্টে যাওয়া শুরু করেন। এর আগে থেকেই অবশ্য তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন। প্রথমে কাজ করতেন দৈনিক আজাদে। পরে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন দৈনিক বাংলা পত্রিকায়।
শহীদ সেরনিয়াবাত পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের হাতে ঢাকার মিন্টো রোডে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। ওই রাতে আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের ছোট ভাই আব্দুর রব সেরনিয়াবাতও শহীদ হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী শহীদ সেরনিয়াবাতের ভাতিজা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় বরিশালের আরও একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম রয়েছে। আগরপুর সড়কের বাসিন্দা ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা মিহির লাল দত্ত। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর একটি দল মিহির লাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে অতর্কিত গুলি চালায়।
এতে ঘটনাস্থলে শহীদ হন মিহির লাল দত্তের বাবা জিতেন্দ্র লাল দত্ত ও ভাই সুধির দত্ত পান্থ। গুলিবিদ্ধ হন মিহির লাল দত্ত নিজেও। রাজাকারের তালিকার বরিশাল সদর অংশের ৯৪ নম্বরে আছে মুক্তিযোদ্ধা মিহির দত্তের নাম, ৯৫ নম্বরে আছে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের নাম।
এ ছাড়া বরিশাল নগরীর কাশিপুর এলাকার সম্ভ্রান্ত মুখার্জি পরিবারের কর্ণধার ছিলেন জগদিশ চন্দ্র মুখার্জি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন যশোর কারাগারে বন্দি। অথচ তার নামও রাজাকারের তালিকায় উঠেছে বলে অভিযোগ করেন তার স্বজন মানিক মুখার্জি।
এমআরএম