দেশে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড
বাংলাদেশে ১৬৬ বছরের ইতিহাসে এবার সর্বকালের সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে। চলতি মৌসুমে (নভেম্বর পর্যন্ত) ৮ কোটি ৫০ লাখের অধিক কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে; যা ২০১৬ সালের ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি রেকর্ড উৎপাদনকে পেছনে ফেলে বছর শেষে ৯ কোটি লাখে পৌঁছাবে।
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চা উৎপাদনের ইতিহাসে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। কিন্তু তার পরের বছর উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৭ কোটি ৮০ লাখ কেজিতে। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ কোটি ২০ লাখ কেজি উৎপাদন হয়।
কিন্তু চলতি বছরে ইতোমধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজির অধিক চা উৎপাদন হয়েছে। বছর শেষে উৎপাদন দাঁড়াবে ৯ কোটি কেজি। এটি সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদের ফলে চা শিল্পের উপর থেকে অনেক শঙ্কা কেটে যাবে, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে চায়ের চাহিদা বছরে ৯ কোটি কেজি। ২০১০ সাল থেকে এই চাহিদা পূরণ করতে চা আমদানি শুরু হয়। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। চা আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে কি-না এ নিয়ে যে শঙ্কা জন্মে ছিল গত কয়েক বছরে চা উৎপাদনের মাধ্যমে কেটে গেছে।
চা উৎপাদনের রেকর্ড নিয়ে চা বাগান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সঠিক সময়ে কীটনাশক ব্যবহার, অনুকূল আবহাওয়া, পুরাতন বাগানে নতুন করে আবাদ এবং অনাবাদি জমিতে চা চাষের কারণে উৎপাদনে এই সফলতা এসেছে।
কমলগঞ্জের চাতলাপুর চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার ইফতিখার আলম বলেন, গত বছর আমার বাগানে চায়ের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ কেজি। এই বছরে তা ১১ লাখ কেজি পৌঁছাবে। ভালো আবহাওয়া এবং ব্যবস্থাপনার কারণে কারণে ১ লাখ কেজি চা আমাদের বাগানে বেশি উৎপাদন হয়েছে।
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার গৌতম দেব বলেন, উৎপাদনের দিক থেকে আমরা ডিসেম্বর মাস শেষ হওয়ার আগেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫% এগিয়ে আছি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চলতি বছর ১১ লাখ কেজি চা উৎপাদন। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বছর শেষে ১৬ লাখ কেজিতে পৌঁছাবে আমাদের চা উৎপাদন।
গৌতম দেব আরও বলেন, ইতোমধ্যে কোনো কোনো চা বাগান ৫% থেকে ২০% পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার থেকে উৎপাদনে এগিয়ে আছে। ফলে মোট চা উৎপাদন বেড়েছে।
বাংলাদেশ চা সংসদের (সিলেট বিভাগ) চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, পরিমিত বৃষ্টি, পরিমিত রোদ, পরিমিত আবহাওয়া সঠিক থাকলে চা উৎপাদন বাড়বেই। চলতি বছর চমৎকার আবহাওয়া ছিল। সেই সঙ্গে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পুরাতন গাছ ফেলে নতুন রোপণ করেছি আমরা। ফলে এবার চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০% এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছি। বছর শেষে ৯ কোটি কেজিতে পৌঁছাবে এবার চা উৎপাদন। যা নতুন রেকর্ড।
তিনি আরও বলেন, সামনে চা উৎপাদন আরও বাড়বে। সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সহায়তার পাশাপাশি কমমূল্যে সার ও কীটনাশক সরবরাহ করলে আমরা আরও উপকৃত হব। চা উৎপাদনে আমারা স্বনির্ভর হলেও চোরাই পথে ভারত থেকে নিম্নমানের চা আসছে, যা চা শিল্পের জন্য হুমকি। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
চা গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে চা উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। চা বাগানের নামে লিজ নেয়া জমির সঠিক ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক মনিটরিং, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, কমমূল্যে সার-কীটনাশক সরবরাহ ও ক্লোনিং চা গাছ রোপণ করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। চা চাষের জন্য লিজ নিয়ে ভিন্ন খাতে ভূমি ব্যবহার হয়।
প্রসঙ্গত, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের সময় দেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। তখন ৩ কোটি কেজির মতো চা উৎপাদন হতো। বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৬টিতে।
এর মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯২টি চা বাগান। বাকিগুলো হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে সাতটি, রাঙ্গামাটিতে দুটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৯ একর।
রিপন দে/এএম/এমকেএইচ