‘ঘর-বাড়ি সব ভেঙে দিয়েছে, তাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে এসেছি’
‘আমরা বেঙ্গালুরু থেকে এসেছি। পুলিশ ও গাওয়ালারা (স্থানীয়রা) আমাদের সেখানে টিকতে দেয়নি। ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। কোনো উপায় না পেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে এসেছি। বর্ডারে আসার পর গাওয়ালারা আমাদের বিএসএফের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। বিএসএফ জিজ্ঞাসা করেছিল বাড়িঘর কোথায়? বলেছি বাংলাদেশে। তখন তারা আমাদের ঠিকানা রেখে নদী পার করে দিয়েছে। নদী পার হয়ে এদিকে আসার পর বিজিবি আমাদের ধরেছে’ এমন কথাই জানিয়েছেন ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক ভারত থেকে অনুপ্রবেশকারীরা।
সম্প্রতি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারত থেকে অবৈধভাবে নারী, পুরুষ ও শিশুদের অনুপ্রবেশ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে নারী, পুরুষ ও শিশু আসছে। দিন যতই যাচ্ছে তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) বিজিবির হাতে আটক হয়েছে চার শিশুসহ নয়জন। এ নিয়ে চলতি মাসে ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের সময় প্রায় ২৬০ জনকে আটক করেছে ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।
আটকদের দাবি, তারা সবাই বাংলাদেশি। কাজের সন্ধানে ভারত গিয়েছিল। তবে তাদের কাছে কোনো দেশেরই পাসপোর্ট বা বৈধ কাগপত্র পাওয়া যায়নি। একই রকম ভাষ্য বিজিবিরও। যেসব নারী-পুরুষ সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আটক হচ্ছেন তারা সবাই কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়েছিল।
সম্প্রতি ভারত সরকার সে দেশের আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রকাশ করে। সেখানে নাম না থাকায় নির্যাতনের ভয়ে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে বিজিবি ও জেলা প্রশাসন। তবে ভারত থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি রয়েছে বিজিবির। তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তের ওপারে আরও অসংখ্য নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছে। সুযোগ পেলেই তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে।
মহেশপুর উপজেলায় ভারতীয় সীমান্ত এলাকা রয়েছে ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে কাঁটাতারবিহীন সীসান্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার। বিশেষ করে ইছামতি নদী পার হয়ে কাঁটাতারবিহীন এলাকা দিয়েই বেশি অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
আটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনআরসিতে তালিকা প্রকাশের পর ভারতে স্থানীয়দের নির্যাতন, ঘরবাড়ি ভাঙচুরসহ নানা ভয়ভীতির চাপে তারা বাংলাদেশে আসছেন। নিজেদের তারা বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু আসলেই বাংলাদেশের নাগরিক এমন প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
বিজিবি বলছে, আটক ব্যক্তিদের বেশিরভাগই কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। তারা জানিয়েছে, এনআরসি আতঙ্ক ও নানা চাপের কারণে তারা ভারত ছেড়েছেন।
জলুলী সীমান্তবর্তী যাবদপুর ইউপি চেয়ারম্যান এবিএম শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, যারা এদেশে আসছে তাদের বেশিরভাগই ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লিতে গিয়ে কাজ করতো। তাদের অনেকের বাড়ি বাংলাদেশে। আবার অনেকে পাকিস্তান আমলে গেছেন। তিনি বলেন, মহেশপুর উপজেলার যাদবপুর, বাঁশবাড়িয়া, কাজিরবেড়, নেপা, শ্যামকুড় ও স্বরূপপুর- এই ছয়টি ইউনিয়ন ভারত সীমান্তবর্তী। এর মধ্যে যাদবপুর সীমান্তের কোদলা নদী এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। তাছাড়া এ বছর বৃষ্টিও তেমন হয়নি। যে কারণে নদী শুকিয়ে গেছে। ফলে কোদলা নদীর ওপর দিয়ে দালালদের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে ঢুকছে। শুধু কোদলা নদী সীমান্ত নয়, অন্যান্য সীমান্ত দিয়েও তারা ঢুকছে বলে জানান তিনি।
সালমা নামে আটক এক নারী জানান, তারা বেঙ্গালুরু থাকতেন। এখন স্থানীয়রা তাদের থাকতে দিচ্ছে না। ওখানে মানুষ মারছে, ধরছে, হাজতে দিচ্ছে। তারা খুব অত্যাচার করছে। তাদের এক মাস সময় দিয়েছে, এ কারণে আমরা চলে এসেছি। তাদের কোনো পাসপোর্ট নেই।
আটক আরেক নারী জানান, তারা বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন। তার স্বামী কাজ করতেন সেখানে। ভারতের পুলিশ বলেছে, সেখানে থাকা যাবে না, চলে যেতে হবে। তারা যে এলাকায় থাকতেন, যাদের বাড়িতে কাজ করতেন তারাও একই কথা বলছে। তাই ভয় পেয়ে চলে এসেছেন।
আটক আক্কাস বলেন, ভারতে প্লাস্টিক টোকাতেন। ওখানে পুলিশ অনেক ঝামেলা করছিল। বলেছে, সেখান থেকে চলে না আসলে ডাইরেক্ট গুলি করে দেবে, নইলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। সেই ভয়ে সীমান্তে এসে চারদিন অবস্থান করেন। তারপর বিএসএফ ধরে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। বাংলাদেশে ঢুকতে বিএসএফ তাদের সহযোগিতা করেছে।
মহেশপুরের কাঞ্চনপুর গ্রামের আহসান হাবিব জানান, সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিনই মানুষ অবৈধভাবে যাওয়া-আসা করে। স্থানীয় ভাষায় তাদের ‘ধুড় পাচার’ বলে। ছোটবেলা থেকে তারা এমনটা দেখে আসছেন। বর্তমানে ভারত থেকে আসা লোকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদুল আলম বলেন, আটকদের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট অধ্যাদেশ আইনে মামলা হয়েছে। তাদের সবাইকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
৫৮ বিজিবির অতিরিক্ত পরিচালক মেজর কামরুল হাসান জানান, ভারত থেকে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ পাসপোর্ট ছাড়াই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। সীমান্তে এ ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। টহলও জোরদার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতের আসামে গত ৩১ আগস্ট এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়। এতে ঠাঁই হয়নি ১৯ লাখের বেশি মানুষের নাম। বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছে ১৩ থেকে ১৪ হাজার হিন্দু নারী-পুরুষও আছে। তালিকা প্রকাশের পর এই বিপুলসংখ্যক মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। যদিও গত ৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কিছু নেই। সর্বশেষ গত বুধবার ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এমএমজেড/পিআর
সর্বশেষ - দেশজুড়ে
- ১ হাতীবান্ধায় ধান কাটাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মেম্বারসহ আহত ১০
- ২ দাওয়াত না পাওয়ায় তাফসির মাহফিল বন্ধ করলো বিএনপি নেতা
- ৩ বাংলাদেশের সংস্কৃতি খুবই চমৎকার: ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত
- ৪ সিদ্ধিরগঞ্জে শেখ হাসিনাসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা
- ৫ নির্যাতনের শিকার সব নেতাকর্মীদের পাশে থাকবে বিএনপি: ডা. জাহিদ