ফ্লোরে সোহার নিথর দেহ, বাবা-মাকে নিয়ে ঢাকার পথে অ্যাম্বুলেন্স
রাত পৌনে ৩টা। নীরবতার চাদরে সবাই ঘুমে বিভোর। ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ বিকট শব্দে। চোখ খুলে অনেকেই দেখলো চারদিক রক্তাক্ত। বাঁচার আর্তনাদ, চিৎকার আর আহাজারি।
মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) রাত পৌনে ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা ও সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষের পর এমন দৃশ্য দেখা যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী।
অনেকেই এখনও খুঁজে পাননি স্বজনদের। এরই মধ্যে দুটি শিশুর রক্তাক্ত দেহ মনে দাগ কেটেছে সবার। এদের মধ্যে একটি শিশু জীবিত থাকলেও অপর শিশুর নিথর দেহ পড়ে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের ফ্লোরে। তার নাম সোহা মনি (৩)। সে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার সোহেল মিয়ার মেয়ে।
ট্রেন দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও মা-বাবার কোলে ছিল শিশু সোহা। মুহূর্তের ব্যবধানে মা-বাবার কোল থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় সে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের ফ্লোরে এখন পড়ে আছে সোহার নিথর দেহ। তার মতো আরও ১৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সোহাসহ ১৬ জনের লাশ উদ্ধার করেছে বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।
এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন সোহার বাবা সোহেল মিয়া ও মা নাজমা বেগম। তাদেরকে উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সোহেল ও নাজমাকে নিয়ে যখন ঢাকায় যাওয়া হচ্ছিল তখন সোহার মামা জামাল মিয়া ভাগনির লাশ বুঝে নিতে হাসপাতালের মর্গ আর পুলিশের কাছে দৌড়াদৌড়ি করছেন। সোহার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া বাড়ি নিয়ে যেতে চান মামা জামাল মিয়া। ভাগনির লাশ নিতে সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন তিনি।
নিহত সোহার মামা জামাল মিয়া বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এখানে ছুটে আসি। হাসপাতালের ফ্লোরে সোহাকে এভাবে দেখব কল্পনাও করিনি। সোহার বাবা-মাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সোহার লাশ নিতে আবেদন করেছি আমি।
এদিকে, হাসপাতালের ফ্লোরে সোহার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে কাঁদছে সবাই। হাসপাতালে আনার পর তার পরিচয় পাওয়া না গেলেও কিছুক্ষণ পর জানা যায় হবিগঞ্জের সোহেল মিয়ার মেয়ে সোহা।
ট্রেন চালকের ভুলের কারণেই ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন মন্দবাগ রেল স্টেশনের মাস্টার জাকির হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, আউটার ও হোম সিগন্যালে লালবাতি (সর্তক সংকেত) দেয়া ছিল। কিন্তু তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল অমান্য করে ঢুকে পড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
জেলা প্রশাসক হায়াৎ উদ-দৌলা খান জানিয়েছেন, চালকের ভুলেই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার পরপরই রেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। পরে ফায়ার সার্ভিস, ও পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার কাজে যোগ দেন।
তূর্ণা নিশীথার যাত্রী কাজি ফজলে রাব্বি বলেন, উদয়ন এক্সপ্রেস ঢোকার আগেই বিপরীত দিক থেকে তূর্ণা নিশীথা এসে ধাক্কা দেয়। আমরা তখন ঘুমিয়েছিলাম। শব্দ পেয়ে আমরা তাড়াতাড়ি করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।
উদয়ন এক্সপ্রেসের যাত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের ট্রেনটি লাইন ক্রস করার সময় দ্রুত গতিতে এসে তূর্ণা ধাক্কা দেয়। আমি সামনের বগিতে থাকায় আহত হইনি। পেছনের তিনটি বগির যাত্রীরা গুরুতর আহত হয়েছেন।
মন্দবাগের স্থানীয় বাসিন্দা সালাম বলেন, গভীর রাতে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। ঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখি কান্নার শব্দ। এখানে সেখানে ছিটকে পড়ে আছে মরদেহ। পরে এলাকার সবাই বেরিয়ে আহতদের উদ্ধার করার চেষ্টা করি।
এমএএস/এএম/এমকেএইচ