আ.লীগের পরিচয়ে ১০ বছরে ৫শ কোটি টাকার মালিক আতাউর
নরসিংদীতে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দেশে-বিদেশে গত ১০ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর। দেশে-বিদেশে নামে বেনামে সহায়-সম্পত্তি ও মিল ফ্যাক্টরিসহ প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।
বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়তে তিনি রাজস্ব ফাঁকি দেয়াসহ নানা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রেফতারের পর আতাউরের নানা অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। মুখ খুলছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে জালিয়াতিসহ নানা অপকর্মের খবর বেরিয়ে আসার পর বিতর্কিত আতাউরের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দলের বিতর্কিত নেতাদের ব্যক্তিগত দায় দল নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু।
এদিকে ব্যাংকের দায়ের করা জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলায় সুইডেন আতাউরকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। রোববার দুপুরে শতকোটি টাকার মোল্লা স্পিনিং মিল অবৈধ দখলের মামলায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আক্তার পিংকির আদালতে তোলা হলে বিচারক এ আদেশ দেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মালিবাগ থেকে সুইডেন আতাউরকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শুক্রবার বিকেলে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাইনুউদ্দিন কাদিরের আদালতে তাকে সোপর্দ করা হয়। ওই মামলার তদন্তকারী সিআইডি’র কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালতের বিচারক রোববার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এরই প্রেক্ষিতে রোববার তাকে আদালতে তোলা হলে আদালতের বিচারক তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এসময় বিচারক তাকে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে পরপর তিনদিন জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
মোল্লা স্পিনিং মিল দখলের অভিযোগে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে দায়বদ্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির অবৈধ দখলদার সুইডেন আতাউর রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার করেছে মিলটির ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট বিভাগের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় দখলদার উচ্ছেদের দাবি জানান।
প্রথমে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করলেও প্রভাবশালী মহলের নানা তদবিরে তা বাধাগ্রস্ত হয়। এরই প্রেক্ষিতে মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। দেশের চলমান শুদ্ধি অভিযানের সময় এ মামলায় বহুল আলোচিত ভূমিদস্যু সুইডেন আতাউরকে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার মালিবাগ থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী শহরের হাজিপুর এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আতাউর রহমান গত ২০ বছর আগে অবৈধপথে সুইডেন পাড়ি জমান। সেখানে এক বৃদ্ধ নারীকে বিয়ে করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পত্তি আত্মসাৎ করে মালিক বনে যান। সেই টাকায় সুইডেনের স্টকহোম ক্রিসেন্টাল সংলগ্ন স্থানে রিও নামে একটি দোকান খোলেন। পরে তিনি সুইডেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
২০০৩ সালের দিকে নরসিংদী শহরের পশ্চিম কান্দাপাড়ায় ছয় তলাবিশিষ্ট সুইডেন ভিলা ভবন নির্মাণ করে প্রথমে স্থানীয়দের নজরে আসেন সুইডেন আতাউর। এরপর তিনি ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় ব্যবহার করে মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকা ভেজাল জমি খুঁজে বেড়ান। কয়েক বছরের ব্যবধানে নরসিংদী বাজারের গেঞ্জিপট্টি মোড়ে অন্যের জমি দখল করে পাঁচ তলাবিশিষ্ট সুইডেন প্লাজা গড়ে তোলেন। এখানেই ক্ষান্ত হননি সুইডেন আতাউর। প্রভাব খাটিয়ে ২০১৬ সালে শহরের বাগহাটা এলাকার শতকোটি টাকা মূল্যের মোল্লা স্পিনিং মিল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোড় করে দখল করে নেন। এভাবে তিনি পার্শ্ববর্তী আমজাদ ভুইয়া ও মতিন মোল্লার নির্মাণাধীন ম্যানচেস্টার কম্পোজিট নামক একটি কারখানা অবৈধভাবে দখল করতে মালিকদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, সুইডেন আতাউর বিএনপির পদধারী কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে শহরের খালপাড় এলাকায় হাবিবুল্লাহ মিয়ার ১২ শতাংশ জমি দখল করেন। বাগহাটা এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী আহমেদ হোসেনের ২০ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করেন। সদর উপজেলার পাঁচদোনায় মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকা ৬৯ শতাংশ জমি দখল করেন। সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়নের কান্দাইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১০০ বিঘা জমি দখল করতে মালিকদের হুমকি দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ২০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছেন।
সুইডেন আতাউরের ঘনিষ্ঠরা জানান, ঢাকার অভিজাত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৮ শতাংশ জমির একটি প্লট রয়েছে। গাজীপুরের টঙ্গীতে রয়েছে তার ১০ শতাংশ জমি। নরসিংদী শহরের দগরিয়ায় মিস্টিক ফার্মাসিটিক্যালের পেছনে ৮০ শতাংশ জমি, ব্রাহ্মন্দী পুরাতন টাউন হলের পেছনে ৫ শতাংশ জমি ছাড়াও নামে বেনামে অনেক স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে তার নামে।
অভিযোগ রয়েছে, সুইডেন বাংলা টেক্সটাইল মিলে কটন সুতা ব্যবহার করা হলেও বন্ড সুবিধার মাধ্যমে টেনসিল, পলিস্টার ও বিসকস তুলা আমদানি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন। এর মাধ্যমে তিনি সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন।
রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সুইডেনে সফরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীসহ বড় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে দেশে এর প্রভাব বিস্তার করেন। একই সঙ্গে সুইডেন আতাউর ইতোপূর্বে পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পোস্টার ব্যানার করে নিজেকে নেতা হিসেবে জাহির করেছেন।
সুইডেন আতাউরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী পরেশ সূত্রধর জানান, কান্দাইলের হিন্দু সম্পত্তিটি আতাউরসহ আমরা তিনজন কিনেছি। কিন্তু আতাউর জমির টাকা দিলেও সেই জমি আমার নামে কিনেছেন। পুরো জমি এখনও আমাদের দখলে নেই। অনেক জমি বেদখল। সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
মোল্লা স্পিনিং মিলের পরিচালক রাশেদুল হাসান রিন্টু বলেন, সুইডেন আতাউর আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে আমাদের মিলসহ অসহায় অনেক মানুষের জমি দখল করে নিয়েছে। এভাবে তিনি অবৈধভাবে কয়েকশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর চলমান শুদ্ধি অভিযানে তিনি গ্রেফতার হওয়ায় আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আমরা আমাদের বেদখল হওয়া মিল ফিরে পেতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি।
জানতে চাইলে নরসিংদী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হীরু জাগো নিউজকে বলেন, বিতর্কিত কোনো নেতার দায় আওয়ামী লীগ কেন নেবে? আতাউরের অপরাধগুলো আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
এদিকে, আতাউর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি উল্লেখ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তার ব্যাখ্যা দিয়েছে সুইডেন আওয়ামী লীগ। গত ১ নভেম্বর সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম জাহাঙ্গীর কবির ও সাধারণ সম্পাদক ডা. ফরহাদ আলী খান স্বাক্ষরিত এক প্রেস নোটে জানানো হয়, আতাউরকে সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি উল্লেখ করে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। আতাউর রহমান সুইডেন আওয়ামী লীগের বর্তমান বা সাবেক কোনো কমিটিরই সভাপতি নন। সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ কর্তৃক অনুমোদিত ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক স্বীকৃত সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম জাহাঙ্গীর কবির ও সাধারণ সম্পাদক ডা. ফরহাদ আলী খান। গ্রেফতার হওয়া আতাউর রহমান প্রায় তিন বছর ধরেই সুইডেন ছেড়ে সপরিবারে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সুইডেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
এমএএস/এমএস