ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

মিয়ানমারের সিম ব্যবহারে ঝুঁকছেন রোহিঙ্গারা

সায়ীদ আলমগীর | কক্সবাজার | প্রকাশিত: ০৮:৫৩ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মোবাইল সিমের মাধ্যমে দেশটির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে। টেকনাফ-উখিয়ার সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এই নেটওয়ার্কের সুবিধা গ্রহণে ঝুঁকছে বেশি। রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক অপরাধ দমনে উখিয়া-টেকনাফে বাংলাদেশি মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমিত রাখায় মারাত্মক সমস্যায় রয়েছেন স্থানীয়রা। ফলে ক্যাম্পে ও ক্যাম্পের আশপাশে ইন্টারনেট ব্যবহার ও মুঠোফোনে কথা বলতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় মোটেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মী, প্রশাসনসহ নানা পেশাজীবীরা বেকায়দায় পড়েছেন। এসব দুর্ভোগ এড়াতে মিয়ানমারের সিমই ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর থেকে কৌশলে বাংলাদেশি সিম সংগ্রহ করে এতোদিন কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন রোহিঙ্গারা। কিন্তু গত ২৫ আগস্টের মহাসমাবেশের পর থেকে উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। ফলে স্থানীয়দের মতো রোহিঙ্গারাও মুঠোফোনে আগেরমতো যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ফলে বিকল্প হিসেবে তারা মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের সিম সংগ্রহ এবং মিয়ানমারে অবস্থানরত বিভিন্ন আত্মীয়দের মাধ্যমে মোবাইলে রিচার্জ করছেন এসব সিম ব্যবহারকারিরা। মুঠোফোনের ডিসপ্লেতে ইংরেজিতে ‘এমপিটি’ লেখা দেখা গেছে। ০৯৮৯১৬৮৮.., ০৯২৬৩১৭৯৬.., ০৯৪০৯৩২০৪.. এভাবে এসব সিমেও ১১ ডিজিট রয়েছে।

মিয়ানমারের সিম ব্যবহারকারি রোহিঙ্গারা জানান, টেকনাফের জাদিমুড়া, হ্নীলা, নয়াপাড়া, মুচনী এসব ক্যাম্প নাফ নদীর তীরে হওয়ায় মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি ভালই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের চেয়েও বেশি কার্যকর সেবা দেয় এ নেটওয়ার্ক।

অপরদিকে, উখিয়ার ক্যাম্পগুলো নাফনদী থেকে একটু দূরে হলেও বালুখালী, পালংখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পগুলোর সড়কের কাছাকাছি এলাকায় মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি ভালই মিলছে। তবে ভেতরের ক্যাম্পগুলোতে এ সুবিধা পাওয়া কষ্টকর।

কুতুপালংয়ের সালামত খান নামে এক রোহিঙ্গা জানান, আমরা আরাকানে থাকাকালীন বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করতাম। এ পারের পরিচিত অনেকে তখন রিচার্জ করে দিতেন। মোবাইলে অভ্যস্ত রোহিঙ্গারা এখন মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে নেট দুনিয়ার সঙ্গে রয়েছে। ওপারে থাকা রোহিঙ্গারা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকেও স্বজনরা অনেককে রিজার্জ করে দেয়।

ক্যাম্প এলাকায় কোথায় রিচার্জ হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাদিমুড়া ও হ্নীলায় এবং বালুখালীতে কয়েকটি দোকানে মিয়ানমারের সিম ও রিচার্জ পাওয়া যেত। কিন্তু বাংলাদেশি প্রশাসনের সতর্ক দৃষ্টির পর এখন দোকানে এসব বিক্রি হয় না। কৌশলে হাতে হাতে বিক্রি চলছে। বিশেষ করে টেকনাফ থেকে মিয়ানমারের সিমসহ তিন রোহিঙ্গা আটকের পর খুবই সন্তর্পনে চলছে মিয়ানমারের সিম বিক্রি।

স্থানীয় আইটি বিশেষজ্ঞরা জানান, টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় মোবাইল ফোনের বেশ কয়েকটি টাওয়ার স্পষ্ট দেখা যায়। উখিয়া সীমান্ত দিয়ে অবশ্য এটি দেখা যায় কম। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে নদী ছাড়া গাছগাছালি কম হওয়ায় নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি বেশি মিলছে। আর উখিয়া সীমান্তে গাছ-গাছালি বেশি হওয়ায় এখানে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক কাজ করে কম।

জানা যায়, বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গার দিয়ে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১৫টি সিম উত্তোলন করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশি এনআইডি না থাকলেও রোহিঙ্গারা কয়েক লাখ সিম ব্যবহার করতো। নামে-বেনামে ব্যবহার করা সিমে বিদেশে তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তারা।

সম্প্রতি টেকনাফে যুবলীগ নেতা ওমর হত্যা ও উখিয়ায় মহা-সমাবেশসহ কয়েকটি ঘটনায় ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে রোহিঙ্গারা। মহাসমাবেশে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার ঘটনা ও একই রকমের টি-শার্ট, বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড কীভাবে পেলো তা নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ শুরু হয়। এ ঘটনায় ক্যাম্পে কর্মরত কতিপয় এনজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এবং তাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, গত ২২ আগস্ট আরাকানে প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ থাকলেও স্বেচ্ছায় যেতে রাজি না হওয়ায় একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাটানো যায়নি। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সশস্ত্র উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ চ্যাট করে প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণা ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের হুমকি দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।

ফলে সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্প এ্যলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সীমিত রাখার ঘোষণা দেয়। এর প্রেক্ষিতে নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনায় পড়ে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক নির্ভর হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। তারা মিয়ানমার থেকে সিম এনে ব্যবহার করছে। সরকারের সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। ক্যাম্পের ভেতর মোবাইল জব্দের কোনো অভিযান না হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা স্থানীয়দের।

শালবাগান ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ২০০ টাকায় সিম সংগ্রহ করেছি। মিয়ানমারে থাকা আত্মীয়রা রিচার্জ করে দেন।

এদিকে চাহিদার কারণে মিয়ানমার থেকে সে দেশের সিম আনছে একটি চক্র। সেই চক্রের তিনজনকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে টেকনাফ স্থল বন্দরের প্রধান গেট এলাকা থেকে আনসারের সহযোগিতায় পুলিশ আটক করে। পরে তাদের তল্লাশি করে ২২২টি মিয়ানমারের ‘এমপিটি’ নামে সিম উদ্ধার করা হয়। বন্দরে মিয়ানমারের ট্রলারে আসা এসব সিম তারা উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিচ্ছিল।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মিয়ানমারের সিমসহ আটক তিন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকিদের ধরতে চেষ্টা চলছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল মনছুর জানান, রোহিঙ্গাদের মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এতে স্থানীয়রা ভোগান্তি পেলেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সিম ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারা এখন মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আসছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইন অমান্য করলে মানবিকতার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

এমএমজেড/পিআর

আরও পড়ুন